উখিয়া–টেকনাফ সীমান্তে ট্রলার ও ট্রাক ভর্তি ইউরিয়া যাচ্ছে মিয়ানমারে, ইয়াবার বিনিময়েও চলছে চোরাচালান
উখিয়া–টেকনাফ সীমান্তে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে সার পাচার চক্র। সরকারি ভর্তুকিযুক্ত ইউরিয়া সার এখন সীমান্তপথে মিয়ানমারে পাচারের প্রধান পণ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিরাতে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর উপকূল হয়ে দেশি ট্রলার ও ফিশিং বোটে টনকে টন সার পাচার হচ্ছে সীমান্তের ওপারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড টেকনাফের সেন্টমার্টিনগামী একটি ট্রলার থেকে ৬০০ বস্তা ইউরিয়া সার জব্দ করেছে। আরও এক অভিযানে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন সাগরপথে আটক হয়েছে ১৩ জন পাচারকারী ও ৪৩০ বস্তা সার। কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, পাচারকারীরা স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে সরকারি দামে সার কিনে মিয়ানমারে পাচার করছিল। প্রতিটি বস্তায় ছিল ভর্তুকিযুক্ত সার, যার দাম মিয়ানমারে তিনগুণ বেশি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ এহসান উদিন জানান, টেকনাফ থেকে বড় ধরনের সার পাচারের তথ্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই৷ তবে সমুদ্র পথে সার পাচারের কিছু তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। উপজেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান ও মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। মনিটরিং-এ যেখানেই কোন অনিয়ম পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই অভিযান চালিয়ে সার জব্দ করে, নিলাম ও মামলা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া–টেকনাফ অঞ্চলে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় রয়েছে যারা ইয়াবার বিনিময়ে সার ও ওষুধ পাচার করে থাকে। কৃষি উপদেষ্টা সাম্প্রতিক এক সভায় বলেন, সীমান্তে এখন নতুন ধরণের চোরাচালান চলছে—সারের বিনিময়ে ইয়াবা ও নেশাজাত দ্রব্য আসছে দেশে। এই অভিযোগের পর থেকেই সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
উখিয়ার পালংখালী, রত্নাপালং ও রাজাপালং ইউনিয়নের কয়েকটি গুদামে সম্প্রতি শত শত সার বস্তা উধাও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সরকারি দামের সার পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি সার সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, পাচারের সঙ্গে কিছু অসাধু ডিলার, পরিবহন ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত।
এদিকে সরকারি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বিসিআইসি কর্তৃক উখিয়ায় নিযুক্ত ডিলারদের বিরুদ্ধে সার পাচারের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসন সম্প্রতি পৃথক দুটি অভিযানে ৬০৭ বস্তা সার জব্দ করেছে। অভিযানে ধরা পড়ে উখিয়া সদরের আহমদ কবির ও কোটবাজারের জাহেদুল আলমের গুদাম থেকে মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে মজুদ রাখা সার।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামানাশিষ সরকার অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হোসেন চৌধুরী জানান, সরকারি অনুমোদন ছাড়া সার মজুদ ও পাচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কৃষকের স্বার্থে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়েছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে। জড়িতরা যেই হোক তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর কোটবাজার এলাকায় একই ডিলার জাহেদুল আলমের গুদাম থেকে ৩৯০ বস্তা নন ইউরিয়া সার জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন। মেম্বার মোহাম্মদ আলীর ছেলে জাহেদুল আলম দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সার পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে উখিয়া থানার ওসি মো. জিয়াউল হক নিশ্চিত করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম বলেন, সার পাচার মানে শুধু সরকারি সম্পদের ক্ষতি নয়, এটি দেশের কৃষি উৎপাদনের ওপর সরাসরি আঘাত। ভর্তুকিযুক্ত পণ্য বিদেশে চলে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাষ্ট্র হারায় অর্থ ও আস্থা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সীমান্তে পাচার রোধে বিশেষ নজরদারি চলছে এবং উখিয়া–টেকনাফ এলাকার ডিলারদের তালিকা পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তাঁর মতে, যেখানে প্রশাসনিক দুর্বলতা বা রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, সেখানেই পাচারের বিস্তার ঘটছে।
স্থানীয় নাগরিক সমাজের মতে, বহুদিন ধরে ইয়াবা ও স্বর্ণ পাচারের জন্য এ সীমান্ত এখন নতুন করে সার পাচারের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—বিগত একযুগেরও দীর্ঘ সময় এত মাত্রায় সার পাচারের ঘটনা ঘটেনি, এখন কেন সীমান্তে পাচারের এই মহোৎসব চলছে? এর পেছনে কারা?
হাইকোর্ট সম্প্রতি ৭২ হাজার টন সার গহরাহরণের ঘটনায় বিসিআইসি’র ব্যর্থতায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে। আদালতের সেই পর্যবেক্ষণের পর বিষয়টি আরও আলোচনায় এসেছে।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উখিয়া–টেকনাফ সীমান্তই এখন সার পাচারের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর নজরদারি এবং সার সরবরাহ ব্যবস্থায় ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু না করলে পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। অন্যথায়, কৃষি উৎপাদন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশের ভর্তুকি অর্থ বিদেশে চলে যাবে পাচারচক্রের হাতে।
বার্তাবাজার/এমএইচ





