তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির বৈঠকে কী হলো, কেন এত উত্তেজনা?

Oct 13, 2025 - 02:00
তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির বৈঠকে কী হলো, কেন এত উত্তেজনা?

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে নিষিদ্ধ তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকি কে আমন্ত্রণ জানিয়ে বৈঠক আয়োজন করার ফলে ভারতকে নতুন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

বিশেষত সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের সুযোগ না দেওয়ায় বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই ঘটনার দায় ভারত সরকার স্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেও- অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এটি দিল্লির কূটনৈতিক অক্ষমতার একটি প্রতিফলন।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। ইতিহাসে এই ভূখণ্ড ধর্মীয় বৈচিত্র্য, সহনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকার এই খ্যাতি বজায় রাখতে ব্যর্থ বলে মনে করছেন সমালোচকরা। ভারত সরকারের দাবি, তাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘চৌকস’ এবং কৌশলী, কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক এখন তলানিতে। বিশেষত আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিষয়টি সুস্পষ্ট।

ভারত-তালেবান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা পাকিস্তানকে অবশ্যই বন্ধু মনে করলেও, আফগানিস্তানের সীমান্ত নিয়ে পাকিস্তানকে ‘বিতর্কিত’ মনে করে। এই দূরত্বই নয়াদিল্লিকে কাবুলের কাছে আরও কাছে নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘শত্রুর শত্রু মিত্র হয়’—এই কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ভারত কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির মধ্যে বৈঠক হয়েছে ১০ অক্টোবর। ভারত সরকার এই বৈঠককে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অংশ হিসেবে দেখেছে। যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতীয়দের বহু পুরোনো বন্ধুত্ব এবং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এছাড়া আফগান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং সামগ্রিক উন্নয়নের প্রসঙ্গও আলোচনা হয়েছে।

ভারত সরকার আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে প্রাণহানিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই দুর্যোগে ভারতের ভূমিকা ও ত্রাণ পাঠানোর প্রশংসা করেছেন। মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভারত আফগানিস্তানে থ্যালাসেমিয়া কেন্দ্র, আধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কাবুলে ৩০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি এবং ইন্দিরা গান্ধী ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের অবকাঠামোগত সংস্কার করবে। এছাড়া আফগানদের উপহার হিসেবে ২০টি অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়া হবে। ভারত আফগান শিক্ষার্থীদের ই-আইসিসিআর বৃত্তি প্রদান অব্যাহত রাখবে এবং ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পুনর্নির্মাণে সহায়তা করবে।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য উভয় পক্ষ ইন্ডিয়া-আফগানিস্তান এয়ার ফ্রেইট করিডর শুরু করার পরিকল্পনা স্বাগত জানিয়েছে। আফগানিস্তান খনিজ সম্পদ খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে চায়। এছাড়া হেরাতে সালমা ড্যামের রক্ষণাবেক্ষণ ও পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে ভারতের সহায়তা প্রশংসা করেছে আফগান সরকার। এই সমস্ত প্রকল্প কৃষি, জ্বালানি ও কৃষি খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বৈঠকে উভয় পক্ষ শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের গুরুত্বও তুলে ধরেছেন। ভারত সরকার আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে মৃত ও আহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং আফগান পক্ষ ভারত সরকারের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ায় সন্তুষ্টি জানিয়েছে। ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাধুলার উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ওপরও আলোচনা হয়েছে।

নয়াদিল্লিতে সফররত তালেবান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বৈঠক। ছবি: জয়শঙ্করের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে সংগৃহীত

তবে বৈঠক এবং যৌথ বিবৃতির সঙ্গে যুক্ত বিতর্কও কম নয়। প্রধান বিতর্ক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই ঘটনায় তীব্র সমালোচনা করেছে। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম মনে করেন, সব পুরুষ সাংবাদিক অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসা উচিত ছিল। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ভারতের জন্য সুরক্ষা ও কূটনৈতিক লাভের সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে এটি সবসময় নিরাপদ কৌশল নয়। পাকিস্তানকে চাপে রাখতে এই সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো ভারতের জন্য ‘হিতে বিপরীত’ ফল দিতে পারে। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মাঝে বিতর্ক এবং সমালোচনা এই প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলছে।

ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসও এই সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। একসময় আফগানিস্তানের তালেবান এবং পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তালেবান পাকিস্তানের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তানের সমর্থনেই তারা আফগানিস্তানে সক্রিয় হয়। তবে ক্ষমতায় আসার পর তালেবানরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দূরত্ব বজায় রাখে এবং কাবুলে স্বাধীনতা রক্ষা করে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নয়াদিল্লি কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে।

ভারত সরকারের দাবি, তাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপ চূড়ান্তভাবে আফগান জনগণের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগী। এটি আফগানিস্তানে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করবে। তবে দেশটির ভিতর এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী অধিকার ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়ানো যায়নি।

এই বৈঠক এবং জটিল পরিস্থিতি ভারতকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। একটি বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে দেশটি কূটনৈতিক সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা ও বিতর্কও তৈরি হচ্ছে। সমালোচকরা মনে করছেন, দিল্লির এই পদক্ষেপ ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মান এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের প্রতি প্রশ্ন তোলেছে।

উপসংহারে, ভারতের তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শুধুই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের সক্ষমতা, নীতি ও মূল্যবোধকে পরীক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। মানবিক সহায়তা, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সংযোগের প্রসার ঘটলেও নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের বিষয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এই কূটনৈতিক পদক্ষেপকে বিতর্কিত করেছে।

ভারতের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—কীভাবে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা হবে, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করা হবে এবং দেশের ভিতরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার রক্ষা করা হবে। এই সব বিষয় ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে।

তথ্যসূত্র: ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কংগ্রেস দল, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

The post তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির বৈঠকে কী হলো, কেন এত উত্তেজনা? appeared first on Citizens Voice.