চীনকে কি শিখর থেকে নামাতে পারবে কেউ?
চীন আজকের বিশ্বে কার্যত প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, “চীনের শতাব্দী” শুরু হয়েছে। তবে এটি সেই “আমেরিকার শতাব্দী” হতে যাচ্ছে না। কারণ চীনের উত্থান ভিন্ন কৌশল ও ভিন্ন পথে—রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, প্রযুক্তিনির্ভর বৃদ্ধি এবং জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক নীতির মাধ্যমে—সংগত।
কয়েক বছর আগে মনে হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বৈশ্বিক আধিপত্যের নতুন স্নায়ুযুদ্ধ হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বাস্তবতা সেই সম্ভাবনাকে অনেকটাই ফিকে করে দিয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের নীতি ও আচরণের কারণে মিত্ররা এখন চীনের বিরুদ্ধের একক জোটে একসাথে দাঁড়াচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি মিত্রদের বিমুখ করেছে, ফলে ইউরোপ, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো মার্কিন অর্থনীতি ও বাজারকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কাজে সহায়ক হয়নি।
ফলে চীন এককভাবে শক্তিশালী অবস্থানে। বাণিজ্যযুদ্ধ এবং শুল্কনীতির প্রভাব মার্কিন উৎপাদন খাতকে দুর্বল করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা—“গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে চীনের উত্থান রোধ করা”—আজ প্রায় অবাস্তব মনে হচ্ছে। বিপরীতে, বেইজিং ক্রমেই আলোচনায় প্রভাবশালী হয়ে উঠছে।
ইতিহাসের শিক্ষণীয় দিক: উত্থান আর পতনের চক্র
ইতিহাস দেখায়, কোনো শক্তি স্থায়ীভাবে শিখরে থাকে না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চারটি শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান ও রাশিয়া—একসাথে উঠেছিল। এর মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই টিকে থাকতে পেরেছিল। জার্মানি ও জাপান নিজেদের ধ্বংস করেছিল যুদ্ধের মাধ্যমে, আর রাশিয়া পড়েছিল রাজনৈতিক অদক্ষতা ও অর্থনৈতিক অসংগঠনের কারণে।
চীনের ক্ষেত্রেও একই ঝুঁকি রয়েছে। তবে এখানে মূল হুমকি অন্যত্র—চীনের অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা এবং কাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো।
জনসংখ্যা সংকট: চীনের ভবিষ্যতের ভুত
চীনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে অনেক বিশ্লেষক দেখছেন জনসংখ্যাগত সংকট। দেশটির প্রজনন হার এখন বিশ্বের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক প্রজন্মের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
এটির প্রভাব বহুমাত্রিক। কর্মক্ষম তরুণ কমে গেলে বৃদ্ধদের বোঝা বাড়বে, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে, আর বিনিয়োগে আগ্রহও কমে যাবে। রোবট ও অটোমেশন কিছুটা ঘাটতি পূরণ করতে পারে, কিন্তু চীনের সবচেয়ে বড় শক্তি—শিক্ষিত মানবসম্পদ—প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব নয়। তবে তাত্ক্ষণিক সংকট এখনও তীব্র নয়; বড় বেবি বুম প্রজন্ম এখনো শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, এবং প্রকৃত চাপ দেখা দেবে ২০৪০-এর দশকের মাঝামাঝি।
অর্থনীতির জটিলতা: ঋণ ও উৎপাদনের দ্বন্দ্ব
চীনের অর্থনীতি বর্তমানে “রিয়েল এস্টেট বুদবুদের” ধসের প্রভাব মোকাবিলা করছে। তিন বছর আগে ফেটে পড়া এই বুদবুদে দেখা দিয়েছে অগণিত মন্দ ঋণ, স্থানীয় সরকারের রাজস্ব সংকট, আর মূল্যসংকোচন।
সরকারি সহায়তা এবং ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তবে এর ফলে উৎপাদন খাতে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। একই ধরনের পণ্য—যেমন ইলেকট্রিক গাড়ি, সৌর প্যানেল, রোবট—একাধিক কোম্পানি উৎপাদন করছে, ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দাম কমছে এবং লাভের মার্জিন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
এটি এক “ম্যাক্রোইকোনমিক ফাঁদ” তৈরি করেছে: অসফল কোম্পানি বন্ধ করলে বেকারত্ব বাড়বে, বাঁচালে পুঁজির অপচয় হবে। ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং প্রাদেশিক স্বার্থের কারণে চীনের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও সংবেদনশীল।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঝুঁকি: শীর্ষ নেতৃত্ব ও বিভাজন
ইতিহাস বলছে, বড় শক্তিগুলোর পতন ঘটে যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে। চীনের ক্ষেত্রে যুদ্ধের হুমকি কম, কিন্তু নেতৃত্ব সংকট ও রাজনৈতিক বিভাজন বড় চ্যালেঞ্জ। শি জিনপিং এখনও উত্তরসূরি নির্ধারণ করেননি। ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় দলীয় অভ্যন্তরে অসন্তোষ বেড়েছে, এবং শি কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শি প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন, এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের হার তিনগুণ বেড়েছে। ইতিহাস বলে, এমন আত্মবিনাশী ক্ষমতাদ্বন্দ্ব এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেও ধ্বংস করতে পারে।
তবে শি জিনপিং বাস্তববাদী পদক্ষেপ নিলে, এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের ঐতিহ্যবাহী কাঠামো ফিরিয়ে আনলে, চীন সম্ভবত আরও কয়েক দশক স্থায়ী থাকতে পারবে।
চীন এখন বিশ্বের প্রধান শক্তি, তবে তার ভবিষ্যত পুরোপুরি নিশ্চয়তামূলক নয়। জনসংখ্যা সংকট, অর্থনৈতিক জটিলতা, এবং রাজনৈতিক বিভাজন—এই তিনটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ চীনের শিখর থেকে নামার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কূটনৈতিক চাপের চেয়ে তার নিজের সীমাবদ্ধতাই বড় হুমকি।
The post চীনকে কি শিখর থেকে নামাতে পারবে কেউ? appeared first on Citizens Voice.





