চুয়াডাঙ্গা ০৮:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাংনীর নারী শ্রমিকেরা শ্রম বৈষম্যের শিকার

মেহেরপুরের গাংনীর কাথুলী গ্রামের ষাটোর্ধ বয়সী নারী শ্রমিক আশরাফুন নেছা কাজ করছেন একটি তামাকের গোডাউনে। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত তামাক বাছাইয়ের কাজ করেন। তাকে দেয়া মজুরী দেয়া হয় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। অথচ তার সাথে পুরুষ শ্রমিকেরা সমপরিমান কাজ করে মজুরি পাচ্ছেন ৫০০ টাকা। অতিরিক্ত সময়ে কাজ করলে তামাকের বেল প্রতি দেয়া হয় ৭০ টাকা। তিনি শুধু তামাক বাছাইয়ের কাজই করেন না। মরিজ তোলা, কচু তোলা,আমের বাগান ধানের জমি সহ বিভিন্ন কৃষি কাজ করছেন অন্তত ১০ বছর। তিনি আরও জানান, স্বামী আয়নাল হক বৃদ্ধ হওয়ায় তাকে আর কেউ কাজে নিতে চাইনা। শুধু আশরাফুন নেছা নয়, তার মতো অনেক নারীই শ্রম বৈষম্যের শিকার।

 

আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নারী পুরুষ উভয়ই সমান ভুমিকা রাখলেও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মেহেরপুরের গাংনীর নারী শ্রমিকেরা। বিশেষ করে শ্রম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। পুরুষদের সমান কাজ করেও তারা মজুরি পাচ্ছেন কম। নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য রোধে বিভিন্ন দাবী সম্বলিত সভা সমাবেশে নারী অধিকার নিয়ে কথা হলেও অদ্যবধি এর কোন সমাধান হয়নি। তবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন আগের চেয়ে নারীরা কম বৈষম্যের শিকার। তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

 

রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আজিজুলের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন জানান, দেশে সব কিছুর দাম বেড়েছে। পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। কিন্তু আমরা পুরষদের সাথে কাজ করেও আমাদের মজুরি পুরুষের অর্ধেক। সারাদিন কাজ করে পাই মাত্র ৩০০ টাকা। এ দিয়ে কোন রকমে সংসারটা বঁঅচিয়ে রেখেছি। মজুরি বৃদ্ধির কথা বল্লে কোন গৃহস্থ আর কাজে ডাকবেনা তাই যা দিচ্ছে তাতেই কাজ করছি।

 

গাড়াবাড়িয়া গ্রামের নারী শ্রমিক ফজলুল হকের স্ত্রী মানুয়ারা বেগম জানান, প্রায় ২০ বছর হলো স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সংসারের খরচ যোগাতে কৃষি কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরী দেয়া হয়। নারীদের মজুরি বৃদ্ধিও বিষয়ে কেই খোঁজ খবর নেয়না। কারও মাথা ব্যথাও নেই।

 

ধলা গ্রামের শুকুর আলীর স্ত্রী মানছুরা জানান, সকাল থেকে কাজ শুরু করি সন্ধে হওে বাড়ি যায়। সংসারে তিনটি মেয়ে। স্বামী বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ কাজে নেয়না তাই শ্রমিকের কাজ বেছে নেন তিনি। সকলেই যখন আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায় কাজ করছে তা হলে আমি বেশি চাইলে দেবে? যা পাচ্ছি তাতেই সন্তষ্ট থাকি। বেশি কিছু বলতে গেলে কেউ আর কাজে ডাকবেনা। তখন খামু কি? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।

 

পুরুষ শ্রমিক জিল্লুর রহমান জানান, নারী পুরুষ সকলেই এক সাথে কাজ করেন। একসাথে কাজে আসা ও যাওয়া। অথচ পুরুষদেরকে বেশি আর নারীদের কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এটা বৈষম্য বটে। এ বৈষম্য দুর করা উচিৎ বলেও দাবী তার।

 

গৃহস্থ রিপন আলী ও খুশি মিয়া জানান, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। পুরুষদের প্রতিদিন ৫০০ টাকা ও নারীদের ৩০০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকরা একটু বেশি কাজ করেন আর নারীরা একটু কম কাজ করেন তাই মজুরিতে পৃথক করা হয়েছে।
মেহেরপুরের উম্মে ছালমা ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও নারী উদ্যোক্তা উম্মে সালমা সুলতানা জানান, সর্ব ক্ষেত্রে নারীরা যখন উন্নয়নে অবদান রাখছে সেই সময়ে মজুরি বৈষম্য তেরী করে নারীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য দুরীকরণে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হলে এই বৈষম্য দুর করা সম্ভব। সমান মজুরি হলে নারীরা আরও সমৃদ্ধিশালী হবে।

 

গাংনী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফারহান ইয়াসমিন জানান, নারীরা অনেক পরিশ্রমী। অসংখ্য নারী আছেন যারা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সংসার ছাড়া হয়ে বাবার সংসারে আছেন। তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন না করে নিজের কর্ম নিজে করে খাচ্ছেন। এমন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন যারা পুরুষের সম পরিমান পরিশ্রম করেন। আর্থ সমাজিক উন্নয়নে নারীদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে শুধু মজুরি বৈষম্য নয় , সব বৈষম্য দুর করলে নারীরা সকল উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আর এর জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।

 

মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা(ভারপ্রাপÍ) নীলা হাপিয়া জানান, জেলায় অসংখ্য নারী শ্রমিক রয়েছেন। যারা কৃষি,শিল্প,মৎস্যমহ বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। তাদের সংসারে উন্নতির পাশাপাশি একটি স্বনির্ভর দেশ গঠনে ভুমিকা রেখে চলেছেন। নারীদের মজুরি বৈষম্য মোটেই কাম্য নয়। নারীরা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গঃ
জনপ্রিয় সংবাদ
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

গাংনীর নারী শ্রমিকেরা শ্রম বৈষম্যের শিকার

প্রকাশ : ০১:২৫:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ মে ২০২৩

মেহেরপুরের গাংনীর কাথুলী গ্রামের ষাটোর্ধ বয়সী নারী শ্রমিক আশরাফুন নেছা কাজ করছেন একটি তামাকের গোডাউনে। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত তামাক বাছাইয়ের কাজ করেন। তাকে দেয়া মজুরী দেয়া হয় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। অথচ তার সাথে পুরুষ শ্রমিকেরা সমপরিমান কাজ করে মজুরি পাচ্ছেন ৫০০ টাকা। অতিরিক্ত সময়ে কাজ করলে তামাকের বেল প্রতি দেয়া হয় ৭০ টাকা। তিনি শুধু তামাক বাছাইয়ের কাজই করেন না। মরিজ তোলা, কচু তোলা,আমের বাগান ধানের জমি সহ বিভিন্ন কৃষি কাজ করছেন অন্তত ১০ বছর। তিনি আরও জানান, স্বামী আয়নাল হক বৃদ্ধ হওয়ায় তাকে আর কেউ কাজে নিতে চাইনা। শুধু আশরাফুন নেছা নয়, তার মতো অনেক নারীই শ্রম বৈষম্যের শিকার।

 

আর্থ সামাজিক উন্নয়নে নারী পুরুষ উভয়ই সমান ভুমিকা রাখলেও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মেহেরপুরের গাংনীর নারী শ্রমিকেরা। বিশেষ করে শ্রম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। পুরুষদের সমান কাজ করেও তারা মজুরি পাচ্ছেন কম। নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য রোধে বিভিন্ন দাবী সম্বলিত সভা সমাবেশে নারী অধিকার নিয়ে কথা হলেও অদ্যবধি এর কোন সমাধান হয়নি। তবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন আগের চেয়ে নারীরা কম বৈষম্যের শিকার। তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

 

রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আজিজুলের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন জানান, দেশে সব কিছুর দাম বেড়েছে। পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। কিন্তু আমরা পুরষদের সাথে কাজ করেও আমাদের মজুরি পুরুষের অর্ধেক। সারাদিন কাজ করে পাই মাত্র ৩০০ টাকা। এ দিয়ে কোন রকমে সংসারটা বঁঅচিয়ে রেখেছি। মজুরি বৃদ্ধির কথা বল্লে কোন গৃহস্থ আর কাজে ডাকবেনা তাই যা দিচ্ছে তাতেই কাজ করছি।

 

গাড়াবাড়িয়া গ্রামের নারী শ্রমিক ফজলুল হকের স্ত্রী মানুয়ারা বেগম জানান, প্রায় ২০ বছর হলো স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। সংসারের খরচ যোগাতে কৃষি কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরী দেয়া হয়। নারীদের মজুরি বৃদ্ধিও বিষয়ে কেই খোঁজ খবর নেয়না। কারও মাথা ব্যথাও নেই।

 

ধলা গ্রামের শুকুর আলীর স্ত্রী মানছুরা জানান, সকাল থেকে কাজ শুরু করি সন্ধে হওে বাড়ি যায়। সংসারে তিনটি মেয়ে। স্বামী বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ কাজে নেয়না তাই শ্রমিকের কাজ বেছে নেন তিনি। সকলেই যখন আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায় কাজ করছে তা হলে আমি বেশি চাইলে দেবে? যা পাচ্ছি তাতেই সন্তষ্ট থাকি। বেশি কিছু বলতে গেলে কেউ আর কাজে ডাকবেনা। তখন খামু কি? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।

 

পুরুষ শ্রমিক জিল্লুর রহমান জানান, নারী পুরুষ সকলেই এক সাথে কাজ করেন। একসাথে কাজে আসা ও যাওয়া। অথচ পুরুষদেরকে বেশি আর নারীদের কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। এটা বৈষম্য বটে। এ বৈষম্য দুর করা উচিৎ বলেও দাবী তার।

 

গৃহস্থ রিপন আলী ও খুশি মিয়া জানান, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। পুরুষদের প্রতিদিন ৫০০ টাকা ও নারীদের ৩০০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকরা একটু বেশি কাজ করেন আর নারীরা একটু কম কাজ করেন তাই মজুরিতে পৃথক করা হয়েছে।
মেহেরপুরের উম্মে ছালমা ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও নারী উদ্যোক্তা উম্মে সালমা সুলতানা জানান, সর্ব ক্ষেত্রে নারীরা যখন উন্নয়নে অবদান রাখছে সেই সময়ে মজুরি বৈষম্য তেরী করে নারীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য দুরীকরণে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হলে এই বৈষম্য দুর করা সম্ভব। সমান মজুরি হলে নারীরা আরও সমৃদ্ধিশালী হবে।

 

গাংনী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফারহান ইয়াসমিন জানান, নারীরা অনেক পরিশ্রমী। অসংখ্য নারী আছেন যারা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সংসার ছাড়া হয়ে বাবার সংসারে আছেন। তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন না করে নিজের কর্ম নিজে করে খাচ্ছেন। এমন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন যারা পুরুষের সম পরিমান পরিশ্রম করেন। আর্থ সমাজিক উন্নয়নে নারীদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে শুধু মজুরি বৈষম্য নয় , সব বৈষম্য দুর করলে নারীরা সকল উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আর এর জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।

 

মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা(ভারপ্রাপÍ) নীলা হাপিয়া জানান, জেলায় অসংখ্য নারী শ্রমিক রয়েছেন। যারা কৃষি,শিল্প,মৎস্যমহ বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। তাদের সংসারে উন্নতির পাশাপাশি একটি স্বনির্ভর দেশ গঠনে ভুমিকা রেখে চলেছেন। নারীদের মজুরি বৈষম্য মোটেই কাম্য নয়। নারীরা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।