২১
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং নানামুখী বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে শেয়ারবাজারে পুরুষের পাশাপাশি নারী বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। গত ৬ বছরের হিসাব অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার।
শেয়ারবাজারের তথ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি নারীদের এ খাতে বিনিয়োগে ভীত করে তুলছে। দেশের শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় না থাকায় নারীরা তাদের সঞ্চয় এখানে বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এছাড়া, বিনিয়োগ শিক্ষার বিষয়ে তুলনামূলক প্রচার কম থাকায় শেয়ারবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না। শেয়ারবাজারের স্টেকহোল্ডাররাও এ বিষয়ের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেন না। তাই, এ সেক্টরে নারীদের অনীহা বেড়েই চলেছে।
নারীদের সঞ্চয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে আনতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই-সিএসই), মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজসহ সব স্টেকহোল্ডারদে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি বছরজুড়ে নারীদের বিনিয়োগের বিষয়ে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নারীরা যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজারে ঝুঁকিমুক্তভাবে বিনিয়োগ করতে পারবেন, সে বিষয়টি প্রচার করতে হবে। সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, এ ধারণা নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে নারী বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।
সিডিবিএলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে নারী নিয়োগকারীর সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছিল।শেয়ারবাজারে ধসের পর এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন প্রায় ২ লাখ নারী বিনিয়োগকারী। ধীরে ধীরে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়ে, তবে তা ২০১০ সালে মতো নয়। ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর দেশের শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৮ লাখ ৬৫ হাজার ২৫০টি। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯২টিতে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত নারী বিও হিসাব কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৮টিতে।
তবে, ২০১৯ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত এ বিও হিসাবের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯২টিতে। তার পর থেকেই কমতে থাকে নারী বিও হিসাবের সংখ্যা। ২০২০ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯১৮টি। ২০২১ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯০টি। ২০২২ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৪১টি। ২০২৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬টি। ২০২৪ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭২৩টি। ২০২৫ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত নারী বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪ হাজার ২৮৭টি। সে হিসাবে গত ৬ বছরের দেশের শেয়ারবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩০৫টি বা ৪৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত এক বছরের ব্যবধানে নারী ও হিসাবের সংখ্যা কমেছে ২৭ হাজার ৪৩৬টি বা ৬.৩৫ শতাংশ।
বর্তমানে চলতি বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত দেশের শেয়ারবাজারে পুরুষ ও নারীর মোট বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩২টিতে। এর মধ্যে পুরুষ বিও হিসাবের সংখ্যা ১২ লাখ ৬৫ হাজার ১১৪টি এবং নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ৪ লাখ ৪ হাজার ২৮৭টি। সে হিসাবে মোট বিও হিসাবের মধ্যে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ২৩.৯৬ শতাংশ। শেয়ারবাজারে মোট বিও হিসাবের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ নারী বিনিয়োগকারীদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) সহকারী অধ্যাপক এবং মহিলা বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক কাশফিয়া শারমিন হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। সে লক্ষ্যে বিআইসিএম কাজ করছে। নারী বিনিয়োগকারী বাড়াতে বছরজুড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও আলোচনা সভা, সেমিনার আয়োজন করে বিআইসিএম। তবে, গত কয়েক বছর ধরে দেশের শেয়ারবাজারে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা আরো কমে গেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে সরকারসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে। শেয়ারবাজারকে গতিশীল করতে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে নীতিগত সুবিধা দিতে হবে, যাতে নারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।
ডেসা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী সালেহা রহমান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, ২০০৯ সালের দিকে নিজের সঞ্চয় করা অর্থ বিনিয়োগ করেছিলাম শেয়ারবাজারে। কিন্তু, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে সৃষ্ট মহাধসে আমি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হই। সে সময় আমার মতো আরো অনেক নারী ও পুরুষ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এরপর দুই-এক বছর বাদে অধিকাংশ সময় শেয়ারবাজার ছিল গতিহীন। ফলে, শেয়ারবাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করার সহস আর পাইনি। সম্প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভেবেছিলাম, শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে এবং গতিশীলতা ফিরে পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন করে বিনিয়োগ করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তবে, শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি যা দেখছি, তাতে বিনিয়োগ করার পরিবেশ নেই। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা না গেলে নারীরা বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন না।