৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা হানাদারমুক্ত দিবস। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এ দিনে মুক্তির স্বাদ পায় গাইবান্ধাবাসী। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বিজয়ের আনন্দে ফেটে পড়ে গাইবান্ধার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ।
গাইবান্ধার আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সারাদেশের মতো গাইবান্ধাও একাত্তরের মার্চের শুরু থেকেই উত্তপ্ত হতে থাকে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয় বিভিন্ন এলাকায়।
২৪ মার্চ শহরের ভিএইড রোডের বার্মা ব্যাংক ভবনে ছুটিতে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ, বিমান এবং আনসার বাহিনীর সদস্যদের এক সভায় প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গাইবান্ধা কলেজ ও ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। প্রশিক্ষণ চলাকালে গাইবান্ধা কলেজের অধ্যক্ষ ওহিদউদ্দিনের সহায়তায় রোভার স্কাউটের ৩০০ কাঠের রাইফেল সংগ্রহ করে পুর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের গাইবান্ধা প্রবেশের আগ পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর প্রশিক্ষপ্রাপ্তরা চলে যায় ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেখানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে অংশ নেন। গাইবান্ধার যুদ্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাদিয়াখালীর যুদ্ধ, হরিপুর অপারেশন, কোদালকাটির যুদ্ধ, রসুলপুর সুইস গেট আক্রমণ, নান্দিনার যুদ্ধ ও কালাসোনার যুদ্ধ।
১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল বিকেলে পাক হানাদার বাহিনী মাদারগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধা প্রবেশ করে। তারা টিঅ্যান্ডটির ওয়ারলেস দখল করে নেয়। পরবর্তীতে গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে (বর্তমান শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়াম) ঘাঁটি করে। এই ঘাঁটি থেকেই তারা শহর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন চালাতে থাকে। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে অসংখ্য মানুষ ধরে এনে হত্যা করার পর মাটিতে পুঁতে রাখে। বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটের পাশেও অসংখ্য লাশ সে সময় পুঁতে রাখা হয়। তাই এই স্থানগুলো পরে বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কতার সঙ্গে গাইবান্ধা শহরের দিকে এগোতে শুরু করে। কিছুদুর এসে রসুলপুর সুইচ গেট উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডিনামাইট সেট করে। কিন্তু সেটা অকেজো হয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা কি পাড়া চলে আসে। রসদ ফুরিয়ে গেলে সেখান থেকে তারা রসুলপুরে ফিরে যায়। এ সময় পাকিস্তানি বিমান থেকে ওই এলাকা এবং মোল্লাচর বোমা বর্ষণ করলে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দু’টি বিমান গাইবান্ধা রেলস্টেশনের পাশে বোমা ফেলে এবং বিকেলে ট্যাংক নিয়ে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করে শহরে। অন্যদিকে, কোম্পানি কমান্ডার বীর প্রতীক মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের কালাসোনার চর থেকে বালাসী ঘাট হয়ে গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে আগের রাতেই গাইবান্ধা শহর স্টেডিয়ামে অবস্থিত পাক সেনা ক্যাম্পের সৈনিকরা রংপুর ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে পালিয়ে যায়। ফলে বর্তমান স্বাধীনতা প্রাঙ্গণ ও তৎকালীন এসডিও মাঠে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার মিলন মেলায় পরিণত হয়। ১০ সহস্রাধিক মানুষ সংবর্ধনা জানায় বিজয়ী বীর সেনাদের। এরআগে ৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানা। ৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় সুন্দরগঞ্জ। একে একে মুক্ত হয় সাদুল্লাাপুর, সাঘাটা ও পলাশবাড়ী উপজেলা।