সোহরাব আলী বিশ্বাস, বয়স ৮১ পেরিয়েছে। ১৯৪২ সালের মার্চে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। স্কুলজীবনে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী ফুলহরি গ্রামের ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অভাবের কারণে ১৯৬২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালেই সোহরাবকে স্কুল ছাড়তে হয়। বকেয়া রয়ে যায় ছয় মাসের বেতন ২৪ টাকা।
স্কুল ছাড়ার ৬১ বছর পর জীবন সায়াহ্নে এসে সোহরাব আলী গত মঙ্গলবার ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে সেই ছয় মাসের বেতন পরিশোধ করেছেন। টাকার মূল্যমান অনেক বাড়ায় বকেয়া হিসেবে তিনি জমা দিয়েছেন ৩০০ টাকা। তাঁর এমন কাজে খুশি স্কুলের শিক্ষক ও এলাকাবাসী। তাঁর বেতন পরিশোধের ছবিটি নিজেদের ফেসবুক পেজেও শেয়ার করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
সোহরাব বিশ্বাস জানান, পড়াশোনা ছাড়ার পর যশোরে গিয়ে পুলিশ সদস্য হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু সেখান থেকেও চলে আসেন দুই মাস পর। এর পর থেকে মহম্মদপুর গ্রামে কৃষি কাজ করতেন বাবার সঙ্গে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চলে যান ভারতের নদীয়া জেলার বেতাই যুব ক্যাম্প এলাকায়। তাঁর দাবি, পুলিশের প্রশিক্ষণ থাকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেতাই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হয়ে যান। স্বাধীনতার পর চলে আসেন দেশে।
এর পর থেকে কৃষি কাজ করেই সংসার চালাতেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তবে সন্তানদের কেউ সঙ্গে না থাকায় সেনাবাহিনীতে চাকরি করা এক নাতিকে নিয়েই তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিনা বেগম থাকেন। বর্তমানে সোহরাব আলী নিজের ও স্ত্রীর বয়ষ্ক ভাতা আর নাতির দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় সংসার চালাচ্ছেন।
সোহরাব আলী বলেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবি আর কত দিনই বাঁচব! বেতন বকেয়া রেখে মারা গেলে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। কিন্তু চেষ্টা করেও পারতাম না পরিশোধ করতে। অবশেষে নিজেদের ভাতার টাকা ও নাতির দেওয়া টাকা জমিয়ে রসিদ কেটে বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছি। বর্তমান বাজার মূল্যে বকেয়া বেতনের টাকা হয়তো বেশি হবে।
তবুও বেতন শোধ করে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। এখন আমার খুবই ভালো লাগছে। আল্লাহর কাছেও বলতে পারব আমি বকেয়া রাখিনি।’ তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম না ওঠায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রানা পারভেজ বলেন, সোহরাব আলী যখন বেতন পরিশোধ করলেন, তখন তাঁর চোখেমুখে যে আনন্দ ছিল, সেটা দেখার মতো। তিনি এত বছর পর বকেয়া বেতন পরিশোধ করলেন জেনে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। আমি নিজে মোটরসাইকেলে করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি।
শৈলকুপার ইউএনও রাজিয়া আক্তার চৌধুরী জানান, সোহরাব আলীর বেতন পরিশোধের বিষয়টি খুবই ভালো লাগার। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি তাঁর কাছে থাকা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমাদের দিলে যাচাই-বাছাই করে সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।