রেলপথে টিকিট কাটা নিশ্চিত ও কালোবাজারি রোধে বহুবার ‘বিশেষ’ সিস্টেম নামে অ্যাপস চালু হয়েছিল। কখনো কাউন্টারে, কখনো অনলাইনে।
আবার মোবাইল নাম্বারের বিপরীতে ‘টিকিট যার-ভ্রমণ তার’ এমন উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। এসবে সাধারণ যাত্রী তথা খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও সুফল পায়নি।
বরং অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে সহজ না হয়ে জটিলের দিকে গেছে একেকটি উদ্যোগ। এবার সাত শর্তে নতুন নিয়মে আজ থেকে টিকিট বিক্রি শুরু করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
‘টিকিট ফাঁকির দিন শেষ’, এমন স্লোগানে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে টিকিট বিক্রি নিশ্চিত করা হবে।
আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটিং, টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পস (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিন ব্যবহৃত হবে।
নতুন এ নিয়মে যাত্রীর যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত নিশ্চিত করে ভ্রমণ করতে হবে। একই সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমে কেনা টিকিট অনলাইনেই ফেরত দেওয়া যাবে।
আজ নতুন নিয়মে টিকিট বিক্রি-যাত্রী ভ্রমণ পরিদর্শনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাবেন রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, পূর্বের নিয়মে পাঁচ দিন আগে কাটা টিকিটে ভ্রমণ সমস্যা হবে না। শিশুরা (১৮ বছরের নিচে) মা-বাবার নিবন্ধনে টিকিট কাটতে পারবে।
আজ থেকে শুধু ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনে সাত শর্তে টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে।
বাকি ২৫৫টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন যাত্রীদের টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ে আধুনিক কোনো ব্যবস্থা আসেনি।
রেলে মোট যাত্রীর ৩ ভাগ চলে ২৫৫টি ট্রেনে। এসব ট্রেনের টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ে চলে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি।
এমন অবস্থায় ফের নতুন নিয়মে টিকিট বিক্রি নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
এর আগে যেসব অ্যাপস রাগ-ঢাক করে উদ্বোধন করা হয়েছিল, তাতে সবকটি প্রক্রিয়া সহজ না হয়ে জটিল হয়েছে।
কাউন্টার কিংবা অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও টিকিট কাটতে পারেননি সাধারণ মানুষ।
কিন্তু, টিকিট কালোবাজারি এবং রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী খুব সহজেই টিকিট পেতেন।
এমন অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে।
এ বিষয়ে রেলওয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে জানান, বুধবার থেকে সম্পূর্ণ নতুন নিয়মে সবকটি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি হবে। আগের কোনো নিয়ম-পদ্ধতি থাকছে না। নতুন এ নিয়েমে প্রতিটি যাত্রীকে সাতটি শর্ত শতভাগ মেনে টিকিট ক্রয় এবং ট্রেনে চলতে হবে।
সাতটি শর্তে টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের জরিমানাসহ ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে নতুন এ ব্যবস্থায় তিনটি সেবা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
ট্রেনের প্রতিটি কামড়ায় বিশেষ অ্যাপস ‘পয়েন্ট অব সেলস (পস) মেশিন দিয়ে টিকিট যাচাই করা হবে।
এছাড়া টিকিট নিশ্চিতকরণ ছাড়া কোনো যাত্রী ট্রেনে উঠতে পারবে না।
বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে নতুন এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন নিবন্ধনের নিয়ম ও শর্ত : টিকিট কাটতে ১২ বছর বা তার বেশি বয়সি সবাইকে নিবন্ধন করতে হবে।
টিকিট কেনার আগে প্রত্যেক যাত্রীকে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট যাচাই করে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত হলে, কাউন্টার, অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টিকিট কাটতে পারবে।
অনলাইনে টিকিট কেনার সময় যে যাত্রী ভ্রমণ করবেন তার এনআইডি লাগবে। যাত্রীর এনআইডি যাচাই করা হবে।
কাউন্টার থেকে টিকিট কিনতে হলে আগাম নিবন্ধন করতে হবে।
তারপর এনআইডি দেখিয়ে স্টেশন থেকে টিকিট কাটা যাবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে https://eticket.railway.gov.bd রেজিস্টার অপশনে গিয়ে নিজের মোবাইল নম্বর, এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
তারপর কোথা থেকে ট্রেনে উঠবেন, গন্তব্য, ভ্রমণের তারিখ, কোন শ্রেণিতে ভ্রমণ করবেন সেগুলো সিলেক্ট করে দিলেই পছন্দের সিট বেছে নেওয়ার অপশন আসবে।
এরপর অনলাইনে পেমেন্ট সম্পন্ন করলেই টিকিট নির্ধারিত যাত্রীর নামে বুক হয়ে যাবে।
এ ছাড়া rail sheba app এ গিয়ে সাইন আপ করেও টিকিট কাটা যাবে। এজন্য একই ধরনের তথ্য দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।
কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা : আবার কাউন্টারে টিকিট করার ক্ষেত্রে মোবাইল থেকে মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করতে হবে BR<space>NID নম্বর <space> জন্মতারিখ (সাল/মাস/দিন) এসএমএস পাঠাতে হবে ২৬৯৬৯ নম্বরে।
ফিরতি এসএমএস-এর মাধ্যমে নিবন্ধন সফল বা ব্যর্থ হয়েছে কিনা, তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
এরপর কাউন্টারে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট দেখালে যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারবে।
অর্থাৎ আগের মতো কাউন্টারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যে সিস্টেমে টিকিট কাটা যেত, তা আর সম্ভব হবে না।
শিশুদের ক্ষেত্রে (১২ থেকে ১৮ বছর) : শিশুদের ক্ষেত্রেও টিকিট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে।
যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই বা যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে, তারা বাবা বা মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করা অ্যাকাউন্ট অথবা নিজেদের জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদ আপলোড করে নিবন্ধনকৃত অ্যাকাউন্ট দিয়ে টিকিট কিনতে পারবেন।
এরূপ ক্ষেত্রে টিকিটের উপরে মুদ্রিত নামের সঙ্গে যাত্রীর সম্পর্ক যাচাইয়ের জন্য ভ্রমণের সময় বাধ্যতামূলকভাবে জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে হবে।
বিদেশি নাগরিকদের জন্য : বিদেশি নাগরিকরাও সহজে টিকিট কাটতে পারবে। এ জন্য, পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ও পাসপোর্টের ছবি আপলোড করে নিবন্ধন সম্পন্ন করা যাবে।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে হবে। এ ছাড়া সব যাত্রীর অবশ্যই নিজস্ব এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি অথবা পাসপোর্ট/ছবি সম্বলিত আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।
এদিকে যারা পূর্বের নিয়মে পাঁচ দিন আগে টিকিট কেটেছে, তারা ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবে। নতুন নিয়ম কড়াকড়ি হবে ৫ মার্চ থেকে।
কারণ, আজ থেকে আগামী ৫ মার্চ পর্যন্ত নতুন নিয়মেই টিকিট কাটতে হবে। অর্থাৎ ৫ দিন আগে যারা পূর্বের নিয়মে টিকিট কেটেছে, তাদের ভ্রমণে কোনো সমস্যা হবে না।
সাধারণ যাত্রী মনে সংশয় : সাধারণ যাত্রীদের একটি বড় অংশের বক্তব্য, এর আগেও রেলে যেসব অ্যাপস চালু করা হয়েছিল, সব কয়টিতেই জটিলতা বেড়েছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি পদে পদেই ছিল। সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই প্রযুক্তির সুবিধার বাইরে রয়েছে।
আবার অনেকের অনলাইনে বা অফলাইনে নিবন্ধন বা লগইন করার পারদর্শিতা নেই। অনেকের কাছে মোবাইল ফোনই নেই।
সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটত। এখন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অ্যাপস ব্যবহার করে টিকিট নিশ্চিত করতে পারলেই টিকিট কাটা সম্ভব হবে।
অনেকেই জানিয়েছে, এমনটা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এমন পদ্ধতি সাধারণ মানুষের জন্য নয়, একটি সুবিধাবাদি গোষ্ঠীর জন্য। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা লেখাপড়াই জানেন না।