৪১
অদম্য নারী উদ্যোক্তা শারমিন সুলতানা শেলী। তার হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় পাটজাত পণ্য জীবন্ত হয়ে উঠে। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ছেলের অনুপ্রেরণায় আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। দেশের গন্ডি পেরিয়ে তার হাতের তৈরি পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হওয়ার পথে। তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প, ব্যবসার শুরু-প্রসার, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলাসহ নানা বিষয়ে হ্যালো বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন।
কেন একজন উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে জাগলো? আপনার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে চাই।
আমার স্বামী দু’বার ব্রেন স্ট্রোক করেন। তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। তখন আমার ছেলে চিন্তা করল মাকে কোন কাজে ব্যস্ত রাখাতে হবে, একা রাখা যাবে না। সে আমাকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন বা বিসিকে ভর্তি করিয়ে দিল। সময়টা ২০২২ সালের নভেম্বর মাস। বিসিকে দু’মাসের একটা প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হলাম। শুরু থেকেই প্রথম হওয়ার লক্ষ্য ছিল আমার। সেখানে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। আমার হাতের কাজের ফিনিশিং সবার চেয়ে ভালো ছিল। কিছু ইউনিক কাজ করেছিলাম। কোর্স সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করলাম। বিসিকের প্রশিক্ষকদের সহযোগিতায় পাটজাত পণ্যের ছোট ছোট অর্ডার পেতে শুরু করলাম। তারপর আস্তে আস্তে বর্তমান পর্যায়ে আসা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনে পুরো কৃতিত্ব ও অনুপ্রেরণা আমার ছেলে শুভ্রর। আমার মেয়েও উৎসাহ দিয়েছে।
নিজের তৈরি পাটজাত পণ্য হাতে শারমিন সুলতানা শেলী। ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
ব্যবসার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
বিসিকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমার ব্যবসার হাতেখড়ি হয়। আমার কাজ দেখে বিসিকের অনেকে অর্ডার দিতে শুরু করে। হাতের কাজের পণ্যগুলো তাদের মন মতো হলো। তাদের দেখে আরও অনেকে অর্ডার (কার্যাদেশ) দিতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে আমার পণ্যের অনেক চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগলো। ২০২৩ সালে ৫টা প্রোডাক্ট দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার প্রোডাক্ট প্রায় ১২০টির মতো। ২০২৪ সালে এসে ব্যবসা জমে উঠে। এখন আমার রূপগঞ্জে কারখানা ও ১৩ জন কর্মী রয়েছে। মানিকগঞ্জে আছে ৭ জন কর্মী। শুরুতে আমার ব্যবসার পুঁজি ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। এখন কয়েক লাখ টাকার অর্ডার আসে মাসে।
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে কি কি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন?
শুরুরদিকে যখন হাতের কাজগুলো নিয়ে রূপগঞ্জে বাবার বাড়ি যেতাম তখন আমার পরিবার থেকে চরম বাঁধার মুখে পড়তে হয়। আপন ছোট ভাই আমার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। আমার মা অনেক ব্যাঙ্গ করেন। অনেকে অনেক নেতিবাচক কথা বলতো। বিশেষ করে মা-ভাইয়ের আচরণে অনেক কষ্ট পেলাম। তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম প্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না, তারপরও আমার কাজ ভালোভাবে চালিয়ে যাবো। আমার স্বামী আমার প্রোডাক্ট নিয়ে অনেক রূঢ় আচরণ করতেন। অনেক সময় প্রোডাক্টগুলো ফেলে দিতেন। এমন আচরণে আমি কাঁদতাম। তখন আমার মেয়ে আমাকে শান্তনা দিতো। আমার ছেলে প্রোডাক্টগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসতো। ছেলে বলতো ‘আম্মু তোমার পাশে আমিতো আছি, আর কি চাও।’ আমি বলতাম তুমি পৃথিবীতে আছো বলে আমি বেঁচে আছি।
উদ্যোক্তা হতে পরিবার, ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন?
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি আমার ছেলের কাছ থেকে। তার সার্জিক্যাল প্রোডাক্টের ব্যবসা রয়েছে। আমার মালামাল ক্রয় থেকে শুরু করে সব বিষয়ে সে দেখাশোনা করে। আমাকে একটা ব্যাগও বহন করতে দেয়না। ব্যাংক বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সহায়তা পায়নি।
আপনার ব্যবসার বর্তমান অবস্থা কেমন? কী কী পণ্য আপনার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে?
আমার প্রতিষ্ঠানের নাম এমএকেজিএন হ্যান্ডিক্রাফট। ব্যবসার বর্তমান অবস্থা মোটামুটি ভালো। রাজধানীর মতিঝিলে আরামবাগে শো-রুম রয়েছে। সেখানে ভালো বিক্রিবাট্টা হয়। মেলাসহ বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে থাকি। সেগুলোতে ভালো সাড়া পাওয়া যায়। গত ৬ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে বা জেডিপিসিতে অনুষ্ঠিত বহুমুখী পাটপণ্য মেলায় আমার প্রোডাক্ট ভালো বেচাকেনা হয়েছে।
বর্তমানে টেবিল রানার সেট, টেবিল-ডাইনিং ম্যাট, ফল রাখার ঝুড়ি, টি কোস্টা, গ্লাস কোস্টা ফুলের টব, শো-পিস, ওয়াল মেট, ওয়াল হ্যাঙ্গার, হাঁড়ি রাখার শিকা, বাবুই পাখির বাসা, ল্যাম্পসহ প্রায় ১২০ ধরনের বাহারি পণ্য রয়েছে আমার ।
ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ
আপনার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়?
আমার পণ্য কয়েকটি দেশে রপ্তানি হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ পাঁচ দেশে প্রোডাক্টের স্যাম্পল পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে জাপানে টেবিল রানার প্রোডাক্টটি সিলেক্ট হয়েছে। কয়েক হাজার অর্ডার পেয়েছি। লন্ডনে দুটি প্রোডাক্ট সিলেক্ট হয়েছে।
আগামীতে ব্যবসার প্রসারের কোন পরিকল্পনা আছে?
আগামীতে বিদেশে ব্যবসার প্রসার করতে চায়। ইউনিক আইডিয়া ও নিখুঁত কাজের মাধ্যমে পণ্যের মান বজায় রেখেছি।
সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন?
সরকারি প্রতিষ্ঠান জেডিপিসি থেকে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সনদ পেয়েছি। আরও একটি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি। আলহাদুলিল্লাহ অল্প সময়ে অনেক সাড়া পেয়েছি, যথেষ্ট ভালো করেছি।
যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
উদ্যোক্তা হতে হলে অনেক ধৈর্য দরকার। পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সৃজনশীল আইডিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করতে হবে। অনেকে নেতিবাচক কথা বলবে, সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে ভালো করা যাবে। নিজের পরিবার, প্রতিবেশীসহ অনেকে কটু কথা বলবে। সেগুলোতে কান দেওয়া যাবে না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী ব্যবসার করতে গেলে কি কি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়? এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
একজন নারী ব্যবসার করতে গেলে প্রথমত স্বামীর কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা আসে। এরপর নিজের ভাই বোনেরা অন্য চোখে দেখে। আত্মীয়-স্বজন থেকে বাঁধা আসে। প্রতিবেশীরা অনেক কটু কথা বলে। এসব কথা না শুনে নিজের কাজটাকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে হবে। আমার উদ্যোগের মাধ্যমে কয়েকজন মানুষ আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়েছে এটাই বড় পাওয়া।