চুয়াডাঙ্গা ০১:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার চুয়াডাঙ্গার রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস

VLUU L100, M100 / Samsung L100, M100

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ভারত সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম  রণাঙ্গনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় এ জেলায়। প্রথমেই চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তানি সরকার এ সিদ্ধান্ত জেনে ফেললে চুয়াডাঙ্গার ওপর পরিকল্পিতভাবে অত্যাচার বাড়ানো হয়।

 

পরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে এবং জীবননগরের সীমান্তবর্তী ধোপাখালী গ্রামের গণকবর, মদনার হৈবৎপুর গ্রামের পাঁচ কবর, নাটুদহের আট কবর, আলমডাঙ্গার লালব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি মহান মুক্তিযুদ্ধে
চুয়াডাঙ্গার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে ১৫ এপ্রিল ঝিনাইদহ দখল করে নেয়। ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা দখলের উদ্দেশ্যে আসার পথে সরোজগঞ্জ বাজারে ও মসজিদে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে জুম্মার নামাজ আদায়রত বহুসংখ্যক মুসল্লি ও সাধারণ মানুষকে হতাহত করে। তারা সরোজগঞ্জ বাজারে হাটের নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭০-৮০ জনকে হত্যা করে। আরেকটু অগ্রসর হয়ে ডিঙ্গেদহ বাজারে গুলি করে ২৫-৩০ জনকে হতাহত করে পথের ধারে প্রায় সকল বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নারী নির্যাতন চালায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর সন্ধ্যা নাগাদ বিনা বাধায় চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। তারা শহরে ঢুকে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে, বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। জনশূন্য এই শহরে শেষ পর্যন্ত যারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করে থেকে গিয়েছিল, তাদের অনেককেই শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গার পর ১৯ এপ্রিল দর্শনা শহর সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করে নেয়।

আলমডাঙ্গা লালব্রিজ ওয়াপদা গার্ড কোয়ার্টার বধ্যভূমি

Alamdanga Boddhobhu

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নর-নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের সাক্ষী এটি। আলমডাঙ্গার কুমার নদের ওপর অবস্থিত লালব্রিজের দু’পাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। রেললাইনের খুলনাগামী লালব্রিজের
আলমডাঙ্গার পাশে একটা এবং নদের অপর পাড়ে কুষ্টিয়ার দিকে কালিদাসপুরে আরেকটি ক্যাম্প ছিল। আসা ট্রেন লালব্রিজের আলমডাঙ্গা মাথায় এবং যাওয়া ট্রেন লালব্রিজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরপরাধ যাত্রীদের ধরে নিয়ে যেত অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখত।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি ঘাতকরা ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামী প্রায় ২ হাজার নারী- পুরুষকে হত্যা করে রেলব্রিজের পাশে ওয়াপদা ভবনের দেওয়ালের মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী দু’টি বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখে। সেই সময় এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলুদ রঙের খালাসি ঘর ছিল। “টর্চার সেল’ নামক সেই হলুদ কক্ষটি ঘিরে এখন বধ্যভূমির স্তম্ভ বা কমপ্লেক্স। মহান বিজয়ের পর এ বধ্যভূমির গর্তে পাওয়া গেছে শত শত মানুষের মাথার খুলি ও অস্থি।

 

নাটুদহের আট কবর

চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় অবস্থিত একটি গণকবর। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রুপ কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জগন্নাথপুর গ্রামের শেল্টার
ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাশের বাগোয়ান গ্রামের।
মুসলিমলীগের দালাল কুবাদ খাঁকে ধরে নিয়ে আসে। ৫ আগস্ট সকালে কুবাদ খাঁর দুজন লোক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয়, রাজাকাররা তাদের ধান কেটে। নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শুনে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামানের নেতৃত্বে একদল
মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য অস্ত্র নিয়ে আনুমানিক ২ কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দুই দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের রেকি দল ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখ ক্ষেতে ‘ইউ’কাটিং অ্যাম্বুশ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের অ্যাম্বুশে পড়ে যায়। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের কাছে থাকা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ব্যবহার করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে থাকে। এ অবস্থায় যেকোনো একজনকে কাভারিং ফায়ার দিয়ে নিজ দলকে বাঁচাতে হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামান স্বাভাবিক ফায়ারের দায়িত্ব নিয়ে শহিদ হন। পিছু হটার সময় তারা অন্য সাথীদের বাঁচাতে পারলেও শহিদ হন ৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদেরকে ঘিরে ফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। পরে জগন্নাথপুর গ্রামের মানুষ রাস্তার পাশে দুটি কবরে চারজন করে আটজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ কবর দেয়। এই আটজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ঘিরেই এ স্থানটির নামকরণ হয়েছে ‘আটকবর’। আটজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- (১) হাসান জামান, গোকুলখালি, চুয়াডাঙ্গা; (২) খালেদ সাইফুদ্দিন তারেক, পোড়াদহ, কুষ্টিয়া; (৩) রওশন আলম, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা; (৪) আলাউল ইসলাম খোকন, চুয়াডাঙ্গা শহর; (৫) আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা শহর: (৬) রবিউল ইসলাম, মোমিনপুর, চুয়াডাঙ্গা; (৭) কিয়ামুদ্দিন, আলমডাঙ্গা এবং (৮) আফাজ উদ্দিন চন্দ্রবাস, দামুড়হুদা।

 

ধোপাখালী গণকবর

jibannagar

জীবননগর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অংশগ্রহণকারী ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তাদের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শহিদের মর্যাদায় কবর দেওয়া হয়, যা ছয় কবর নামেও পরিচিত। ধোপাখালী সীমান্তের জিরোপয়েন্টে সাবেক সেনাপ্রধান মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এতে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং মোস্তাফিজুর রহমান গুরুতর আহত হন। শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ১. হাবিলদার-আব্দুল গফুর, ২. নায়েক-আবদুর রশিদ, ৩. নায়েক-আব্দুল মালেক, ৪. সিপাহী আব্দুল আজিজ, ৫. সিপাহী আবু বকর ও ৬. সিপাহী ছিদ্দিক। এদের প্রত্যেকেই ইপিআর সদস্য ছিলেন। এছাড়াও দর্শনার পাশে মদনা-হৈবৎপুরে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা একসাথে শহিদ হন, যেখানে সাম্প্রতিককালে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

 

সদর হাসপাতাল বধ্যভূমি

চুয়াডাঙ্গা আধুনিক সদর হাসপাতাল ভবনটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করে হত্যা করে। মহান বিজয়ের পর এই হাসপাতালের আশেপাশেই পাওয়া যায় অসংখ্য মানুষের লাশ, হাড়গোড়।

 

নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বধ্যভূমি

দামুড়হুদার নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নির্যাতনকেন্দ্র। অসংখ্য মানুষকে এখানে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালানোর পর হত্যা করা হতো। এই বিদ্যালয়ের পেছনেই আবিষ্কৃত হয়েছে এক বিশাল গণকবর। মহান
বিজয়ের পরপরই এই গণকবরটিতে দুই শতাধিক স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয় বলে জানা যায়।

অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল প্রতিরোধের মুখে পড়ে ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহরমুখী মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের একাংশ শক্তিশালী বোমার
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করতে না পারে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। হানাদার মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা।

Powered by WooCommerce

স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার চুয়াডাঙ্গার রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস

আপডেটঃ ০১:২৩:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ভারত সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম  রণাঙ্গনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় এ জেলায়। প্রথমেই চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তানি সরকার এ সিদ্ধান্ত জেনে ফেললে চুয়াডাঙ্গার ওপর পরিকল্পিতভাবে অত্যাচার বাড়ানো হয়।

 

পরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে এবং জীবননগরের সীমান্তবর্তী ধোপাখালী গ্রামের গণকবর, মদনার হৈবৎপুর গ্রামের পাঁচ কবর, নাটুদহের আট কবর, আলমডাঙ্গার লালব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি মহান মুক্তিযুদ্ধে
চুয়াডাঙ্গার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে ১৫ এপ্রিল ঝিনাইদহ দখল করে নেয়। ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা দখলের উদ্দেশ্যে আসার পথে সরোজগঞ্জ বাজারে ও মসজিদে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে জুম্মার নামাজ আদায়রত বহুসংখ্যক মুসল্লি ও সাধারণ মানুষকে হতাহত করে। তারা সরোজগঞ্জ বাজারে হাটের নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭০-৮০ জনকে হত্যা করে। আরেকটু অগ্রসর হয়ে ডিঙ্গেদহ বাজারে গুলি করে ২৫-৩০ জনকে হতাহত করে পথের ধারে প্রায় সকল বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নারী নির্যাতন চালায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর সন্ধ্যা নাগাদ বিনা বাধায় চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। তারা শহরে ঢুকে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে, বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। জনশূন্য এই শহরে শেষ পর্যন্ত যারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করে থেকে গিয়েছিল, তাদের অনেককেই শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গার পর ১৯ এপ্রিল দর্শনা শহর সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করে নেয়।

আলমডাঙ্গা লালব্রিজ ওয়াপদা গার্ড কোয়ার্টার বধ্যভূমি

Alamdanga Boddhobhu

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও বাঙালি নর-নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের সাক্ষী এটি। আলমডাঙ্গার কুমার নদের ওপর অবস্থিত লালব্রিজের দু’পাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। রেললাইনের খুলনাগামী লালব্রিজের
আলমডাঙ্গার পাশে একটা এবং নদের অপর পাড়ে কুষ্টিয়ার দিকে কালিদাসপুরে আরেকটি ক্যাম্প ছিল। আসা ট্রেন লালব্রিজের আলমডাঙ্গা মাথায় এবং যাওয়া ট্রেন লালব্রিজের কালিদাসপুর প্রান্তে দাঁড় করিয়ে নিরপরাধ যাত্রীদের ধরে নিয়ে যেত অকথ্য নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখত।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি ঘাতকরা ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামী প্রায় ২ হাজার নারী- পুরুষকে হত্যা করে রেলব্রিজের পাশে ওয়াপদা ভবনের দেওয়ালের মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী দু’টি বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখে। সেই সময় এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলুদ রঙের খালাসি ঘর ছিল। “টর্চার সেল’ নামক সেই হলুদ কক্ষটি ঘিরে এখন বধ্যভূমির স্তম্ভ বা কমপ্লেক্স। মহান বিজয়ের পর এ বধ্যভূমির গর্তে পাওয়া গেছে শত শত মানুষের মাথার খুলি ও অস্থি।

 

নাটুদহের আট কবর

চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় অবস্থিত একটি গণকবর। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রুপ কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জগন্নাথপুর গ্রামের শেল্টার
ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাশের বাগোয়ান গ্রামের।
মুসলিমলীগের দালাল কুবাদ খাঁকে ধরে নিয়ে আসে। ৫ আগস্ট সকালে কুবাদ খাঁর দুজন লোক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয়, রাজাকাররা তাদের ধান কেটে। নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শুনে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামানের নেতৃত্বে একদল
মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য অস্ত্র নিয়ে আনুমানিক ২ কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দুই দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের রেকি দল ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখ ক্ষেতে ‘ইউ’কাটিং অ্যাম্বুশ করে।
মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের অ্যাম্বুশে পড়ে যায়। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের কাছে থাকা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ব্যবহার করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে থাকে। এ অবস্থায় যেকোনো একজনকে কাভারিং ফায়ার দিয়ে নিজ দলকে বাঁচাতে হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামান স্বাভাবিক ফায়ারের দায়িত্ব নিয়ে শহিদ হন। পিছু হটার সময় তারা অন্য সাথীদের বাঁচাতে পারলেও শহিদ হন ৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদেরকে ঘিরে ফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। পরে জগন্নাথপুর গ্রামের মানুষ রাস্তার পাশে দুটি কবরে চারজন করে আটজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ কবর দেয়। এই আটজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ঘিরেই এ স্থানটির নামকরণ হয়েছে ‘আটকবর’। আটজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হলেন- (১) হাসান জামান, গোকুলখালি, চুয়াডাঙ্গা; (২) খালেদ সাইফুদ্দিন তারেক, পোড়াদহ, কুষ্টিয়া; (৩) রওশন আলম, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা; (৪) আলাউল ইসলাম খোকন, চুয়াডাঙ্গা শহর; (৫) আবুল কাশেম, চুয়াডাঙ্গা শহর: (৬) রবিউল ইসলাম, মোমিনপুর, চুয়াডাঙ্গা; (৭) কিয়ামুদ্দিন, আলমডাঙ্গা এবং (৮) আফাজ উদ্দিন চন্দ্রবাস, দামুড়হুদা।

 

ধোপাখালী গণকবর

jibannagar

জীবননগর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অংশগ্রহণকারী ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তাদের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শহিদের মর্যাদায় কবর দেওয়া হয়, যা ছয় কবর নামেও পরিচিত। ধোপাখালী সীমান্তের জিরোপয়েন্টে সাবেক সেনাপ্রধান মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
এতে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং মোস্তাফিজুর রহমান গুরুতর আহত হন। শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ১. হাবিলদার-আব্দুল গফুর, ২. নায়েক-আবদুর রশিদ, ৩. নায়েক-আব্দুল মালেক, ৪. সিপাহী আব্দুল আজিজ, ৫. সিপাহী আবু বকর ও ৬. সিপাহী ছিদ্দিক। এদের প্রত্যেকেই ইপিআর সদস্য ছিলেন। এছাড়াও দর্শনার পাশে মদনা-হৈবৎপুরে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা একসাথে শহিদ হন, যেখানে সাম্প্রতিককালে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

 

সদর হাসপাতাল বধ্যভূমি

চুয়াডাঙ্গা আধুনিক সদর হাসপাতাল ভবনটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করে হত্যা করে। মহান বিজয়ের পর এই হাসপাতালের আশেপাশেই পাওয়া যায় অসংখ্য মানুষের লাশ, হাড়গোড়।

 

নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বধ্যভূমি

দামুড়হুদার নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নির্যাতনকেন্দ্র। অসংখ্য মানুষকে এখানে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালানোর পর হত্যা করা হতো। এই বিদ্যালয়ের পেছনেই আবিষ্কৃত হয়েছে এক বিশাল গণকবর। মহান
বিজয়ের পরপরই এই গণকবরটিতে দুই শতাধিক স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয় বলে জানা যায়।

অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল প্রতিরোধের মুখে পড়ে ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহরমুখী মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের একাংশ শক্তিশালী বোমার
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করতে না পারে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। হানাদার মুক্ত হয় চুয়াডাঙ্গা।