বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরা দেশের টাকা পাচার করে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে তিন মহাদেশের আট দেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। গ্রুপটির চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ছেলে সায়েম সোবহান আনভীরসহ পরিবারের আট সদস্যের নামে বিপুল পরিমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশিন (দুদক)। একই তথ্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে।
বিশ্বের তিন মহাদেশের মধ্যে এশিয়া মহাদেশের দু’দেশে সাম্রাজ্য রয়েছে। তা হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুর। ইউরোপ মহাদেশে রয়েছে স্লোভাকিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও সাইপ্রাস। এছাড়া উত্তর আমেরিকায় রয়েছে সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড।
বসুন্ধরা গ্রুপের পাচার করা অর্থের বিষয়ে আটটি দেশে ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর ঢাকার ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন।
দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে বলা হয়, আটটি দেশের প্রায় দুই ডজনের মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এ গ্রুপটি। কোনটি ব্যক্তি কোম্পানি, কোনটি শেয়ারহোল্ডার রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের পরিবারের সদস্যদের নামে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গড়ে তুলেছেন তারা। এ সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক হিসেবে সম্পদ, রিয়েল এস্টেট এবং কর্পোরেট কোম্পানি।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর অধীনে জারি করা আদেশটি পরবর্তী নোটিশ না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। বলেছে আদালত।
যাদের নামে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা হলেন- বসন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (জন্ম ১৯৫২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী পার্সপোর্ট নং-BOO766567) তার স্ত্রী আফরোজা বেগম (জন্ম ১৯৫৬ পাসপোর্ট নং- B00766566)
ছেলে- সায়েম সোবহান আনভির (জন্ম ১৯৮১, পাসপোর্ট নং- B00767634) তার স্ত্রী সাভরিনা সোবহান (জন্ম ১৯৮২, পাসপোর্ট নং- B00766564) অপর ছেলে- সাদাত সোবহান (জন্ম ১৯৬৬, পাসপোর্ট নং- B00328510) তার স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসি সোবহান (জন্ম ১৯৭৮, পার্সপোর্ট নং- B00328511), অপর ছেলে সাফিয়াত সোবহান (জন্ম ১৯৭৭, পাসপোর্ট নং- A08184887) এছাড়া আরেক ছেলে সাফওয়ান সোবহান (জন্ম ১৯৮৬, পার্সপোর্ট নং- A07500363)
দুদকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা আপন দেশকে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অনুসন্ধানে বিশ্বের আটাটি দেশে এ দেশের টাকা পাচার করেছে গ্রুপটি। যার মাধ্যমে তিনটি মাহাদেশে এ গ্রুপটি বিপুল পরিমাণে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
তিনি বলেন, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) অ্যাক্ট অনুসরণ করে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সকলকে শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
আদালতের আদেশের অনুলিপি স্লোভাকিয়ার স্টেট রেজিস্টার, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের সিটিজেন ইন্টারন্যাশনাল, সুইজারল্যান্ডের চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ আর্থিক পরিষেবা শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেড, সিঙ্গাপুর এক্সচেঞ্জে পাঠানো হয়েছে-জানান ওই কর্মকর্তা।
ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যাণ্ডে ১০ কোম্পানি
ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এ বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সাফিয়াত সোবহানের স্ত্রী সোনীয়া ফেরদৌসি সোবহানের নামে দশটি অফসর কোম্পানি তথ্য পাওয়া গেছে। কোম্পানিগুলোর নাম হলো- Asimina Consulting Ins Francatina Development Inc. Somas Group SA. Akebia united SA, Norca Holdings Limited, Somas Group SA, Stat Holdings Services Limited, Francatina Development Inc, cordyline universal, SA francatina development inc.
ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ করস্বর্গ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কর ব্যবস্থার সুবিধা, আর্থিক গোপনীয়তা এবং নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে এ অঞ্চলকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
ক্যারিবিয়ানে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের এ অঞ্চলটি ৫০টিরও বেশি দ্বীপ, ছোট দ্বীপ ও উপদ্বীপ নিয়ে গঠিত। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এ অঞ্চলকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি আদর্শ স্থান হিসেবে গড়ে তুলেছে।
ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এর সুবিধাজনক কর ব্যবস্থা। এখানে কর্পোরেট কর, সম্পত্তি কর, উত্তরাধিকার কর বা বিক্রয় কর নেই। এ কারণেই এটি অফশোর কোম্পানি বা দেশ ভিত্তিক কোম্পানি গঠনের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
২০০৪ সালে প্রণীত বিজনেস কোম্পানি অ্যাক্ট অনুযায়ী, এখানে অফশোর ব্যবসা গঠন প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজতর। ফলে, এ পর্যন্ত ৬ লাখের বেশি কোম্পানি ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে নিবন্ধিত অফশোর কোম্পানির প্রায় ৪০ শতাংশ।.
সুইজারল্যাণ্ডে আট প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরার
ইউরোপ মহাদেশের সুইজারলেণ্ডে বসুন্ধরা গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের নামে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, এ দেশে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের পার্টনার বিজনেস রিলেশনশিফ ছিল- Asimina Consalting inc, Akebia Undated SA, Cordyline Universal SA, Stat Holdings Services Limited, Cessnock LTd, Beeson Ltd, Dreemgarrow Ltd, Agne LA.
সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল অর্থনীতি। দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশটির অর্থনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা সুইজারল্যান্ডকে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পরিচিত করে তুলেছে।
আইল অফ ম্যান (ইউকে)
যুক্তরাজ্যের মধ্যে আইরিশ সাগরে একটি স্ব-শাসিত ব্রিটিশ দীপ আইল অফ ম্যান (ইউকে)। এ দ্বীপটি অর্থনীতি একটি ট্যাক্স হেভেন ও অফশোর ব্যাংকিং এর শক্তিশালী স্থান। এ দ্বীপটি অনলাইন জুয়া, পাচার অর্থ বিনিয়োগের জন্য পরিচিত, আর্থিক অপরাধ এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের সমস্যাও এনেছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সাফিয়াত সুবহান ও তার স্ত্রী সনিয়া ফেরদৌস সুবহানের নামে এ অঞ্চলে প্রায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- cessnock ltd, Benson ltd Dreemgarrow Ltd, Farndon ptd, Agne Ltd.
স্লোভাকিয়ায় বসুন্ধরার সাম্রাজ্য
স্লোভাকিয়া মধ্য ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সায়েম সোবহান আনভির ও তার স্ত্রী সাভরিনা সোবহানের নামে Warders Corporation নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের ১১ মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কোম্পানির মূলধন হচ্ছে এক মিলিয়ন ইউরো।
সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস
সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস উত্তর আমেরিকার একটি দেশ। এ দেশের বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তার স্ত্রীর আফরোজা সোবহানের নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম st. kitts and nevis এ প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ ডলার।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সাফওয়ান সোবহানের নামে হাবিব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯৭০ ডলার রয়েছে। এবং ইউরো রয়েছে ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ডলার। ওই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর হলো- 20127771021100।
যদিও ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট-এর তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ইউরো ট্রান্সফার হয়েছে সোনিয়া ফেরদৌস সোবহানের হাবিব ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে। যে অ্যাকাউন্টে পূর্বে টাকাটি এসেছিল সাইপ্রাস থেকে।
এ গ্রুপটির সিঙ্গাপুরে সোনিয়া ফেরদৌস সোবহানের তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার নাম হচ্ছে IIY holdings pte ltd, IIY Import and Export Pte Ltd. IIY International Pte Ltd.
এছাড়া ইউরোপের দেশ সাইপ্রাসে বসুন্ধরার চেয়ারম্যানের ছেলের স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌস সোবহানের নামে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি হিসাব খোলা হয়। সে হিসাবে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি আরব আমিরাতের হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে তার অন্য একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২৮ কোটি ৬৯ লাখ ৯৮ হাজার ইউরো স্থানান্তরিত হয়েছে।
বিএফআইইউ’র একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আপন দেশকে বলেন, দেশে থেকে বড় বড় যেসব গ্রুপগুলো বিদেশে টাকা পাচার করেছে তাদের টাকা ফেরত আনতে বিদেশে বিভিন্ন ল’ ফার্মের সঙ্গে আমরা চুক্তি করবো।
আমরা খুব দ্রুত সময়ে কয়েকটি বিদেশ ল’ ফার্মের সঙ্গে যুক্ত হবো। তারা ফিরিয়ে আনা টাকার একটি অংশ কমিশন হিসেবে পাবেন। তবে আমরা খুবই গুরত্বতার সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছি-জানান বিএফআইইউ।
বসুন্ধরা গ্রুপের পরিবারের ব্যাংক হিসবা জব্দ রেখেছে বিএফআইইউ
গত অক্টোবরের শুরুতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ তাদের পরিবারের আট সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বিএফআইইউ।
ব্যাংক হিসাব জব্দের তালিকায় থাকা অন্যরা হলেন আহমেদ আকবর সোবহানের চার ছেলে সাদাত সোবহান, সাফিয়াত সোবহান, সায়েম সোবহান আনভীর ও সাফওয়ান সোবহান এবং তিন পুত্রবধূ সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান, সাবরিনা সোবহান ও ইয়াশা সোবহান।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে সেসব হিসাবের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা এবং তাদের নামে কোনো লকার থাকলে তার ব্যবহার ৩০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হলো।
যদিও বিএফআইইউ’র একজন কর্মকর্তা আপন দেশকে বলেন, প্রথমে এক মাসের জন্য এ গ্রুপের মালিকসহ তার পরিবারের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করলেও। সেসব অ্যাকাউন্টগুলো এখনো জব্দের মধ্যে রয়েছে।
আপন দেশ/এবি