চুয়াডাঙ্গা ০১:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চা শিল্প: রপ্তানি হচ্ছে উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ

দেশের চা শিল্পের ইতিহাস ১৮৪ বছরের। দীর্ঘ এই সময়ে চায়ের উৎপাদন ক্রমাগত বেড়েছে। গত বছর রেকর্ড ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চায়ের উৎপাদন হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। অথচ উৎপাদনের সঙ্গে রপ্তানি বাড়েনি, বরং কমেছে। গত এক দশকে সেটা তলানিতে ঠেকেছে। গত বছর দেশে উৎপাদিত চায়ের কেবল ১ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে।

 

দেশে চাহিদার তুলনায় চায়ের উৎপাদন বেশি, অন্য দেশের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি এবং মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করতে না পারার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই শিল্প। চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন এবং খরচ বেশির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঙ্খিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও গুণগত চায়ের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন।

 

অন্যদিকে গুণগত মান বাড়াতে না পারায় আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা তৈরি করে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু রপ্তানি করলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। এমন অবস্থায় চায়ের উৎপাদন আধিক্যই এই শিল্পের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

খুচরা বাজারে দাম বাড়লেও উৎপাদনের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। খরচ তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। ইতোমধ্যে কিছু চা-বাগান বন্ধ হয়েছে এবং আরও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে চা শিল্প এবং এর সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, মোটা দাগে রপ্তানিযোগ্য মানসম্পন্ন চা উৎপাদন না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, কম শুল্কে কফি আমদানি, চোরাকারবারিকে চা শিল্পের সমস্যা। এসব সমস্যা উত্তরণে পরিমাণ কমিয়ে মানসম্পন্ন চা উৎপাদন, রপ্তানিমুখী করে তুলতে আইন সহজ করা এবং সরকারের সহযোগিতার কথা উঠে এসেছে।

বাংলাদেশি চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, চা শিল্পের অবস্থা খুবই নাজুক। আমরা নিলামে চা বিক্রি করি। ২০১৮ সাল থেকে নিলামে চা বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে। আমরা লোকসানের মুখে চলছি।

 

চায়ের ব্যবহার

চায়ে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েড নামের একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা দেহে প্রবেশ করামাত্রই বাড়ায় হৃদযন্ত্রের সক্রিয়তা। রক্তনালি সুস্থ রাখে। শরীরে দেয় তরতাজা ও উৎফুল্ল ভাব। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার শঙ্কাও কমে যায়। চা অভ্যর্থনার পানীয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এর ঔষধি গুণটি সমান্তরালভাবে স্বীকৃত। হরেক রকম চায়ের রয়েছে হরেক রকম ভেষজ গুণ। এ ছাড়াও গাছের সার, কাপড় রং, জুতার দুর্গন্ধ দূর, কার্পেট, কাচ পরিষ্কার, রূপচর্চা ইত্যাদি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে চায়ের।

Tea 1

চায়ের ইতিহাস

হাজার পাঁচেক বছর আগের কথা। একদিন ঘটনাক্রমেই চীনের সম্রাট শেননংয়ের গরম পানির পাত্রে উড়ে এসে জুড়ে বসে রং ছড়ায় একটি পাতা। সেই পাতার নির্যাসযুক্ত গরম পানিটুকু খেয়ে যেন তুড়িতেই উড়ে যায় শেননংয়ের ঘুম আর ক্লান্তি ভাব। তিনি বুঝতে পারেন, যেনতেন নয়, জাদুকরী গুণ ছিল পাতাটির। খোঁজ পড়ে পাতার। মিলে যায় সন্ধানও।

গ্রিক দেবী থিয়ার নামে পাতার নাম রাখা হয় ‘টি’; যা চীনে ‘চি’ উচ্চারিত হতে হতে একসময় হয়ে যায় ‘চা’। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে একটি এই চা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়।

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত ছিল। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে, মতান্তরে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত, মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো। একটি সিলেট জেলায়, যা সুরমা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। অপরটি চট্টগ্রাম জেলায়, যা হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো লস্করপুর, বালিশিরা, মনু-দলই, লংলা এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি। আর হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে৷

চলতি বছরের ১১ আগস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে মোট ১৬৯টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, খাগড়াছড়িতে ১টি, রাঙ্গামাটিতে ২টি, পঞ্চগড়ে ৯টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে।

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৬২ হাজার ৭৩৪ হেক্টরে ১৬৮টি বাগান থেকে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। অথচ ১৯৭০ সালের ৪২ হাজার ৬৮৫ হেক্টর বাগানে উৎপাদিত হতো ৩ কোটি ১৩ লাখ কেজি। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই উৎপাদন হয়েছে ৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এর আগে ২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি, ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি এবং ২০২২ সালে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের চা শিল্পের দেশীয় চাহিদা গড়ে ৯ দশমিক ৫ কোটি কেজি। অর্থাৎ, চাহিদার বেশি চা উৎপাদন হচ্ছে। তবে রপ্তানি বাদ দিলে চায়ের ভোগ অবশ্য এর বেশি। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে চায়ের ভোগের পরিমাণ যথাক্রমে ৮ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার, ৯ কোটি ৫৮ লাখ ২৬ হাজার, ৯ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার, ১০ কোটি ১৮ লাখ ৭৮ হাজার, ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার।

এদিকে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরেও দেশে আমদানি হচ্ছে। চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানি হয়েছে।

রপ্তানি তলানিতে

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২২ বছরে অন্তত ১৩ গুণ কমেছে চায়ের রপ্তানি। ২০০১ সালে চা রপ্তানি হয়েছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ২ হাজার কেজি। ২০২৩ সালে সেটি নেমেছে ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজিতে। আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ২২ লাখ কেজি। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ২১ লাখ ৭০ হাজার, ৬ লাখ ৮০ হাজার এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি।

৫ বছরে রপ্তানি করা চায়ের আর্থিক মূল্য যথাক্রমে ৩৪ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার, ১৮ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার, ১৯ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার, ২৭ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার এবং ৩৮ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।

তথ্য বলছে, দেশি-বিদেশি অন্তত ২২টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানিতে জড়িত থাকলেও তাদের অনেকেরই এখন আর রপ্তানি নেই।

চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, আমাদের রপ্তানি খুবই সামান্য। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদন বেড়ে গেছে। বাজারের যে চাহিদা, তার চেয়ে অনেক বেশি চা আমরা উৎপাদন করছি। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে একটা সাম্যবস্থা নিয়ে না আসতে পারি, তাহলে শুধু উদ্বৃত্তই হতে থাকবে।

কামরান আরও বলেন, আমাদের যে চা উদ্বৃত্ত হচ্ছে, সেটার মান ভালো নয়। এর মূল্য খুবই কম। সিলেটে খারাপ চা হচ্ছে না, তা বলব না। প্রধানত উত্তরবঙ্গ থেকে যেসব আসছে, সেগুলোর মান ভালো নয়। অন্য চা-ও রপ্তানি করতে গেলে দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্বজুড়ে চায়ের উৎপাদন বেশি জানিয়ে কামরান টি রহমান বলেন, চায়ের ভোগ ও উৎপাদনের ২০২৩ সালের হিসাবে সারা পৃথিবীতে ৩৯১ মিলিয়ন কেজি উদ্বৃত্ত দেখা গেছে। দেশেও ৯০ মিলিয়ন কেজি ভোগ। অথচ গত বছর উৎপাদন হয়েছে অফিসিয়ালি ১১২ মিলিয়ন কেজি। আর বেআইনিভাবে যেগুলো বিক্রি হচ্ছে, নিলামে আসছে না, সেগুলো ধরা হলে ১২৫ মিলিয়ন কেজি।

tea 2

দামের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত মে মাসের নিলামে বিক্রি হওয়া ‘বেস্ট’ ক্যাটাগরির চায়ের নিলামমূল্য ছিল ২৮০ থেকে ৩৩০ টাকা, ‘গুড’ ক্যাটাগরির দাম ছিল ২৪৫ থেকে ২৭০ টাকা এবং ‘মিডিয়াম’ ক্যাটাগরির দাম ছিল ২২৫ থেকে ২৩৫ টাকা। সাধারণ চায়ের প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়। সাধারণ মানের সেই খোলা চা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। কোম্পানিগুলোর প্যাকেটে তা ৫০০ টাকার বেশি।

অন্যদিকে চায়ের উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি অনেক বেড়েছে বলে জানান বাগানমালিকেরা। তারা জানান, প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ ঠেকেছে ৩০০ টাকার কাছাকাছি। ২০২৩ সালেও প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ছিল ২৭১ টাকা। তার আগের বছরে ছিল ২৯৭ টাকা।

এ বিষয়ে চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, টংয়ের চা এখন ১০ টাকা। যখন ৫ টাকা ছিল, তখনও চায়ের অংশের খরচ ছিল ৪০ পয়সার নিচে। এখনও সেটা ৪০ পয়সার নিচেই আছে। অন্য সব কিছুর দাম বেড়েছে। এমনকি চা শিল্পের শ্রমিকদের বেতন, ডিজেল, গ্যাস, অন্যান্য সার—যা লাগে হয়, সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। শুধু চায়ের নিলামমূল্য বাড়েনি, কমে গেছে।

চাল শিল্পের জন্য বিষয়গুলো অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক! চায়ের নিলামমূল্য না বাড়লে অচিরেই দেখা যাবে, একের পর এক বাগান বন্ধ হবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিয়ের ১২টি বাগান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেকে চালাতে পারছে না।

ব্যবসায়ী কামরান বলেন, সরকার যদি সহায়তা না দেয়, তাহলে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে তো কম লোক চাকরি করে না। বহুলোকের সংসার চলে এই চা শিল্পে।

দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের চায়ের দাম অনেক কমাতে হবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কীটনাশক, শ্রমিকের বেতন খরচ অনেক বেড়েছে। কেনিয়ায় প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন চার হাজার কেজি, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন মাত্র ১৫শ কেজি। ফলে কেনিয়া যে দামে চা বিক্রি করতে পারবে, আমরা সেই দামে পারব না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিলামে যোগসাজশ করে চায়ের দর কম দিচ্ছে। আবার ভোক্তাদের কাছে দাম অনেক বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিও আছে।

করণীয় কী

দেশে উৎপাদিত বেশিরভাগ চায়ের গুণগত মান উন্নত নয়। ফলে একদিকে যেমন দেশীয় বাজারে ভালো দাম মিলছে না। তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করা যাচ্ছে। কিছু রপ্তানি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে সেগুলোর দাম কম, বিপরীতে উৎপাদন খরচ বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দাঁড়াচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য চায়ের উৎপাদন কমিয়ে গুণগত মান বাড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে কামরান টি রহমান বলেন, আমরা যদি ভালো মানের চা করি, তাহলে উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে। উৎপাদন কমে ৮৫-৯০ মিলিয়ন কেজির মধ্যে যদি আসে, তাহলে দেশীয় বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, দেশে নিলামে ভালো মানের চায়ের দাম রয়েছে। কিছু কিছু ভালো চা উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যেগুলোর লিকারের রেটিং ভালো, কোয়ালিটি চা, সেগুলোর দাম কিন্তু কম যাচ্ছে না। আর যেসব চা দাম পাচ্ছে না, উৎপাদন খরচের নিচে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর গুণগত মান ভালো নয়। যে কারণে নিলামেও সেসব চায়ের জন্য প্রতিযোগিতা হয় না। কোয়ালিটি চায়ের যেভাবে ক্রেতারা আগ্রহী থাকে এবং নিলামে দাম বাড়ে।

আমিরুল ইসলাম বলেন, উৎপাদন একটা পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত উৎপাদনের দরকার নেই। মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করলে উৎপাদন কমে যাবে। দাম পাওয়া যাবে। খারাপ চা বেশি খরচে উৎপাদন করে কম দামে বেচে লাভ কী?

তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে না সেভাবে, তাই চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন না করে মান উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে যথেষ্ট দাম পাওয়া যাবে।

মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা তুলে নিচ্ছে কি-না?—এর জবাবে আমিরুল বলেন, চা কেনার সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ আগাম কর, ব্রোকারেজ খরচ ইত্যাদি দিয়ে চা তুলতে হয়। ২০০ টাকায় এক কেজি চা কিনলে প্রায় ২৩২ টাকা পরিশোধ করে ডেলিভারি নিতে হয়। এরপর ওয়্যারহাউস থেকে আনা। প্যাকেজিংয়ে যাবে। এটার আবার ভ্যাট দিতে হবে। বাজারে চা যাওয়ার পরেও ডিস্ট্রিবিউটরকে বড় ছাড় দিতে হয়। প্যাকেটের দাম দেখে অনেকে মনে করছেন ব্লেন্ডার অনেক লাভ থাকছে, আসলে তা নয়।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা আমিরুল বলেন, উত্তরবঙ্গের কিছু চা সারাদেশে চোরাইভাবে বাজারজাত করা হয়। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করে চা বিক্রি হচ্ছে। এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। এগুলো বাজারে দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। এগুলো বন্ধ করলেও নিলামে চায়ের দাম বাড়বে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, স্থানীয় ভোক্তা তৈরির পাশাপাশি রপ্তানি না বাড়াতে পারলে চায়ের উৎপাদকেরাও টিকে থাকতে পারবেন না।

Tea 3

কী বলছে চা বোর্ড

চা বাগান বন্ধ ও নিম্নমানের চায়ের উৎপাদন সম্পর্কে জানতে চাইলে চা বোর্ডের সচিব (উপসচিব) মিনহাজুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে বাগানগুলোর শ্রমিকদের মজুরি ৮ টাকা ৫০ পয়সা বেড়েছে। এটা অনেক বাগান মালিক হিমশিম খাচ্ছে বলে জানিয়েছে। এটা একটা বড় বিষয়। এটা নিয়ে প্রায় আলোচনা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের চায়ের ক্ষেত্রে কোয়ালিটি ঘাটতি রয়েছে। আসলে আর্থিক সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে, এটা একটা বড় বিষয়।

অন্যদিকে গুণগত চা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে উপপরিচালক (পরিকল্পনা) সুমন শিকদার বলেন, ভালো মানের চা উৎপাদনের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। বাগান মনিটরিং করি। বিভিন্ন পরামর্শ দেই। বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার করি। গুণগত মানের চায়ের উৎপাদনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চায়ের মানোন্নয়নের বিষয়টা বাগান মালিকদের হাতে। চা বোর্ড হাতে কলমে শিখিয়ে দেয়। তারা মান বাড়াতে পারলে নিলামে ভালো দাম পাবে।

সুমন শিকদার বলেন, নিলামে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম পেলে, তাদের গুণগত মান ভালো নয়। এর জন্য তাদেরকেই কাজ করতে হবে। পাতা চয়নের প্রক্রিয়ায় মনযোগ দিতে হবে, প্লাকিং রাউন্ড কমিয়ে আনতে হবে, ফ্যাক্টরি মেশিনারিজ স্থাপন করতে হবে। এভাবে তারা গুণগত মান বাড়াতে পারবে। এতে রপ্তানি করতে পারবে।

গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড চা উৎপাদন হলেও ২০২৪ সালে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছে চা বোর্ড। এ বিষয়ে সুমন শিকদার বলেন, ১০৮ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা। তবে এ বছর আমরা সেটা করতে পারব না। কারণ, এ বছর খরা, এনটিসির বাগানগুলো বন্ধ, পঞ্চগড়ে উৎপাদন কম। পঞ্চগড়ে মূল্য কমে যাওয়ায় সময়মতো পাতা চয়ন করেনি। এ জন্য উৎপাদন হয়েছে। এসব কারণে শেষ পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে।

চা শিল্পের মজুরি বিতর্ক

অন্য খাতের চেয়ে চা শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি কম নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। তবে এ খাতের মজুরির সঙ্গে অন্য খাতের তুলনা করা সঙ্গত নয় বলে মনে করে উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ।

চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, একমাত্র চা শিল্পেই মজুরি দেওয়া হয়— ইন ক্যাশ অ্যান্ড ইন কাইন্ড। ইন ক্যাশ যেটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা ১৭৮ টাকা বর্তমানে। ইন কাইন্ড আমরা রেশন ভর্তুকি দেই। চাল বা গম ২ টাকা কেজিতে দেওয়া হয়। একেকজন শ্রমিক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৪ কেজির মতো গম পায় প্রতি সপ্তাহে। তাদের ঘর আমরা তৈরি করি এবং মেইনটেইন করি। অন্য শিল্পে মেডিক্যাল সার্ভিস বলে কিছু নেই, কিছু টাকার অ্যালাউন্স আছে। আর চা শিল্পে শুধু শ্রমিক নয়, শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সবার জন্য মেডিক্যাল সেবা রয়েছে। তারা অবসর নিলে বা মারা গেলে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল একজনকে তাৎক্ষণিক চাকরি দেওয়া হয়।

কামরান আরও বলেন, একজন শ্রমিক অবসরের পর আজীবন রেশন পায়। শুধু তাই নয়, এই শিল্পে একইসঙ্গে পরিবারের অনেক সদস্য কাজ করতে পারে। পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারে। এটাকে অন্য শিল্পের সঙ্গে মেলালে হবে না। আলাদা করে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, মালিকপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের ‘ক্যাশ অ্যান্ড কাইন্ড’ দিচ্ছে। যেখানে ১৭৮ টাকা ক্যাশ এবং রেশন সাবসিডি, হাউজ ফ্যাসিলিটি, হেলথ ফ্যাসিলিটিসহ অন্য বিষয়কে তারা কাইন্ড বলে মোট মজুরি ৫৭০ টাকা বলছেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

তিনি বলেন, শ্রম আইনের ‘ধারা ২ এর দফা ৪৫(ক) অনুযায়ী বাসস্থান সংস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের মূল্য অথবা সরকার কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা বাদ দেওয়া হইয়াছে—এইরূপ কোনো সেবার মূল্য, মজুরির অর্ন্তভুক্ত হবে না।

Source link

প্রসংঙ্গ :

Powered by WooCommerce

চা শিল্প: রপ্তানি হচ্ছে উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ

আপডেটঃ ০৭:৫৩:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

দেশের চা শিল্পের ইতিহাস ১৮৪ বছরের। দীর্ঘ এই সময়ে চায়ের উৎপাদন ক্রমাগত বেড়েছে। গত বছর রেকর্ড ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চায়ের উৎপাদন হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। অথচ উৎপাদনের সঙ্গে রপ্তানি বাড়েনি, বরং কমেছে। গত এক দশকে সেটা তলানিতে ঠেকেছে। গত বছর দেশে উৎপাদিত চায়ের কেবল ১ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে।

 

দেশে চাহিদার তুলনায় চায়ের উৎপাদন বেশি, অন্য দেশের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি এবং মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করতে না পারার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই শিল্প। চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন এবং খরচ বেশির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঙ্খিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও গুণগত চায়ের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন।

 

অন্যদিকে গুণগত মান বাড়াতে না পারায় আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদা তৈরি করে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু রপ্তানি করলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। এমন অবস্থায় চায়ের উৎপাদন আধিক্যই এই শিল্পের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

খুচরা বাজারে দাম বাড়লেও উৎপাদনের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। খরচ তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। ইতোমধ্যে কিছু চা-বাগান বন্ধ হয়েছে এবং আরও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে চা শিল্প এবং এর সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, মোটা দাগে রপ্তানিযোগ্য মানসম্পন্ন চা উৎপাদন না হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, কম শুল্কে কফি আমদানি, চোরাকারবারিকে চা শিল্পের সমস্যা। এসব সমস্যা উত্তরণে পরিমাণ কমিয়ে মানসম্পন্ন চা উৎপাদন, রপ্তানিমুখী করে তুলতে আইন সহজ করা এবং সরকারের সহযোগিতার কথা উঠে এসেছে।

বাংলাদেশি চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, চা শিল্পের অবস্থা খুবই নাজুক। আমরা নিলামে চা বিক্রি করি। ২০১৮ সাল থেকে নিলামে চা বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে। আমরা লোকসানের মুখে চলছি।

 

চায়ের ব্যবহার

চায়ে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েড নামের একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা দেহে প্রবেশ করামাত্রই বাড়ায় হৃদযন্ত্রের সক্রিয়তা। রক্তনালি সুস্থ রাখে। শরীরে দেয় তরতাজা ও উৎফুল্ল ভাব। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার শঙ্কাও কমে যায়। চা অভ্যর্থনার পানীয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এর ঔষধি গুণটি সমান্তরালভাবে স্বীকৃত। হরেক রকম চায়ের রয়েছে হরেক রকম ভেষজ গুণ। এ ছাড়াও গাছের সার, কাপড় রং, জুতার দুর্গন্ধ দূর, কার্পেট, কাচ পরিষ্কার, রূপচর্চা ইত্যাদি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে চায়ের।

Tea 1

চায়ের ইতিহাস

হাজার পাঁচেক বছর আগের কথা। একদিন ঘটনাক্রমেই চীনের সম্রাট শেননংয়ের গরম পানির পাত্রে উড়ে এসে জুড়ে বসে রং ছড়ায় একটি পাতা। সেই পাতার নির্যাসযুক্ত গরম পানিটুকু খেয়ে যেন তুড়িতেই উড়ে যায় শেননংয়ের ঘুম আর ক্লান্তি ভাব। তিনি বুঝতে পারেন, যেনতেন নয়, জাদুকরী গুণ ছিল পাতাটির। খোঁজ পড়ে পাতার। মিলে যায় সন্ধানও।

গ্রিক দেবী থিয়ার নামে পাতার নাম রাখা হয় ‘টি’; যা চীনে ‘চি’ উচ্চারিত হতে হতে একসময় হয়ে যায় ‘চা’। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে একটি এই চা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়।

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত ছিল। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে, মতান্তরে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত, মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো। একটি সিলেট জেলায়, যা সুরমা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। অপরটি চট্টগ্রাম জেলায়, যা হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো লস্করপুর, বালিশিরা, মনু-দলই, লংলা এবং নর্থ সিলেট ভ্যালি। আর হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে৷

চলতি বছরের ১১ আগস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে মোট ১৬৯টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, খাগড়াছড়িতে ১টি, রাঙ্গামাটিতে ২টি, পঞ্চগড়ে ৯টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান রয়েছে।

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৬২ হাজার ৭৩৪ হেক্টরে ১৬৮টি বাগান থেকে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। অথচ ১৯৭০ সালের ৪২ হাজার ৬৮৫ হেক্টর বাগানে উৎপাদিত হতো ৩ কোটি ১৩ লাখ কেজি। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই উৎপাদন হয়েছে ৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এর আগে ২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি, ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি এবং ২০২২ সালে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের চা শিল্পের দেশীয় চাহিদা গড়ে ৯ দশমিক ৫ কোটি কেজি। অর্থাৎ, চাহিদার বেশি চা উৎপাদন হচ্ছে। তবে রপ্তানি বাদ দিলে চায়ের ভোগ অবশ্য এর বেশি। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে চায়ের ভোগের পরিমাণ যথাক্রমে ৮ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার, ৯ কোটি ৫৮ লাখ ২৬ হাজার, ৯ কোটি ৩০ লাখ ৪৯ হাজার, ১০ কোটি ১৮ লাখ ৭৮ হাজার, ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার।

এদিকে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরেও দেশে আমদানি হচ্ছে। চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানি হয়েছে।

রপ্তানি তলানিতে

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২২ বছরে অন্তত ১৩ গুণ কমেছে চায়ের রপ্তানি। ২০০১ সালে চা রপ্তানি হয়েছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ২ হাজার কেজি। ২০২৩ সালে সেটি নেমেছে ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজিতে। আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ২২ লাখ কেজি। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ২১ লাখ ৭০ হাজার, ৬ লাখ ৮০ হাজার এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি।

৫ বছরে রপ্তানি করা চায়ের আর্থিক মূল্য যথাক্রমে ৩৪ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার, ১৮ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার, ১৯ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার, ২৭ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার এবং ৩৮ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।

তথ্য বলছে, দেশি-বিদেশি অন্তত ২২টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানিতে জড়িত থাকলেও তাদের অনেকেরই এখন আর রপ্তানি নেই।

চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, আমাদের রপ্তানি খুবই সামান্য। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদন বেড়ে গেছে। বাজারের যে চাহিদা, তার চেয়ে অনেক বেশি চা আমরা উৎপাদন করছি। উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে একটা সাম্যবস্থা নিয়ে না আসতে পারি, তাহলে শুধু উদ্বৃত্তই হতে থাকবে।

কামরান আরও বলেন, আমাদের যে চা উদ্বৃত্ত হচ্ছে, সেটার মান ভালো নয়। এর মূল্য খুবই কম। সিলেটে খারাপ চা হচ্ছে না, তা বলব না। প্রধানত উত্তরবঙ্গ থেকে যেসব আসছে, সেগুলোর মান ভালো নয়। অন্য চা-ও রপ্তানি করতে গেলে দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্বজুড়ে চায়ের উৎপাদন বেশি জানিয়ে কামরান টি রহমান বলেন, চায়ের ভোগ ও উৎপাদনের ২০২৩ সালের হিসাবে সারা পৃথিবীতে ৩৯১ মিলিয়ন কেজি উদ্বৃত্ত দেখা গেছে। দেশেও ৯০ মিলিয়ন কেজি ভোগ। অথচ গত বছর উৎপাদন হয়েছে অফিসিয়ালি ১১২ মিলিয়ন কেজি। আর বেআইনিভাবে যেগুলো বিক্রি হচ্ছে, নিলামে আসছে না, সেগুলো ধরা হলে ১২৫ মিলিয়ন কেজি।

tea 2

দামের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত মে মাসের নিলামে বিক্রি হওয়া ‘বেস্ট’ ক্যাটাগরির চায়ের নিলামমূল্য ছিল ২৮০ থেকে ৩৩০ টাকা, ‘গুড’ ক্যাটাগরির দাম ছিল ২৪৫ থেকে ২৭০ টাকা এবং ‘মিডিয়াম’ ক্যাটাগরির দাম ছিল ২২৫ থেকে ২৩৫ টাকা। সাধারণ চায়ের প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়। সাধারণ মানের সেই খোলা চা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। কোম্পানিগুলোর প্যাকেটে তা ৫০০ টাকার বেশি।

অন্যদিকে চায়ের উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি অনেক বেড়েছে বলে জানান বাগানমালিকেরা। তারা জানান, প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ ঠেকেছে ৩০০ টাকার কাছাকাছি। ২০২৩ সালেও প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ছিল ২৭১ টাকা। তার আগের বছরে ছিল ২৯৭ টাকা।

এ বিষয়ে চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, টংয়ের চা এখন ১০ টাকা। যখন ৫ টাকা ছিল, তখনও চায়ের অংশের খরচ ছিল ৪০ পয়সার নিচে। এখনও সেটা ৪০ পয়সার নিচেই আছে। অন্য সব কিছুর দাম বেড়েছে। এমনকি চা শিল্পের শ্রমিকদের বেতন, ডিজেল, গ্যাস, অন্যান্য সার—যা লাগে হয়, সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। শুধু চায়ের নিলামমূল্য বাড়েনি, কমে গেছে।

চাল শিল্পের জন্য বিষয়গুলো অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক! চায়ের নিলামমূল্য না বাড়লে অচিরেই দেখা যাবে, একের পর এক বাগান বন্ধ হবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিয়ের ১২টি বাগান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেকে চালাতে পারছে না।

ব্যবসায়ী কামরান বলেন, সরকার যদি সহায়তা না দেয়, তাহলে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে তো কম লোক চাকরি করে না। বহুলোকের সংসার চলে এই চা শিল্পে।

দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের চায়ের দাম অনেক কমাতে হবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কীটনাশক, শ্রমিকের বেতন খরচ অনেক বেড়েছে। কেনিয়ায় প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন চার হাজার কেজি, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন মাত্র ১৫শ কেজি। ফলে কেনিয়া যে দামে চা বিক্রি করতে পারবে, আমরা সেই দামে পারব না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিলামে যোগসাজশ করে চায়ের দর কম দিচ্ছে। আবার ভোক্তাদের কাছে দাম অনেক বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন ও চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিও আছে।

করণীয় কী

দেশে উৎপাদিত বেশিরভাগ চায়ের গুণগত মান উন্নত নয়। ফলে একদিকে যেমন দেশীয় বাজারে ভালো দাম মিলছে না। তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করা যাচ্ছে। কিছু রপ্তানি হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে সেগুলোর দাম কম, বিপরীতে উৎপাদন খরচ বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দাঁড়াচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য চায়ের উৎপাদন কমিয়ে গুণগত মান বাড়ানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে কামরান টি রহমান বলেন, আমরা যদি ভালো মানের চা করি, তাহলে উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে। উৎপাদন কমে ৮৫-৯০ মিলিয়ন কেজির মধ্যে যদি আসে, তাহলে দেশীয় বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, দেশে নিলামে ভালো মানের চায়ের দাম রয়েছে। কিছু কিছু ভালো চা উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যেগুলোর লিকারের রেটিং ভালো, কোয়ালিটি চা, সেগুলোর দাম কিন্তু কম যাচ্ছে না। আর যেসব চা দাম পাচ্ছে না, উৎপাদন খরচের নিচে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর গুণগত মান ভালো নয়। যে কারণে নিলামেও সেসব চায়ের জন্য প্রতিযোগিতা হয় না। কোয়ালিটি চায়ের যেভাবে ক্রেতারা আগ্রহী থাকে এবং নিলামে দাম বাড়ে।

আমিরুল ইসলাম বলেন, উৎপাদন একটা পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত উৎপাদনের দরকার নেই। মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করলে উৎপাদন কমে যাবে। দাম পাওয়া যাবে। খারাপ চা বেশি খরচে উৎপাদন করে কম দামে বেচে লাভ কী?

তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে না সেভাবে, তাই চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন না করে মান উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে যথেষ্ট দাম পাওয়া যাবে।

মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা তুলে নিচ্ছে কি-না?—এর জবাবে আমিরুল বলেন, চা কেনার সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ আগাম কর, ব্রোকারেজ খরচ ইত্যাদি দিয়ে চা তুলতে হয়। ২০০ টাকায় এক কেজি চা কিনলে প্রায় ২৩২ টাকা পরিশোধ করে ডেলিভারি নিতে হয়। এরপর ওয়্যারহাউস থেকে আনা। প্যাকেজিংয়ে যাবে। এটার আবার ভ্যাট দিতে হবে। বাজারে চা যাওয়ার পরেও ডিস্ট্রিবিউটরকে বড় ছাড় দিতে হয়। প্যাকেটের দাম দেখে অনেকে মনে করছেন ব্লেন্ডার অনেক লাভ থাকছে, আসলে তা নয়।

টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা আমিরুল বলেন, উত্তরবঙ্গের কিছু চা সারাদেশে চোরাইভাবে বাজারজাত করা হয়। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করে চা বিক্রি হচ্ছে। এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। এগুলো বাজারে দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। এগুলো বন্ধ করলেও নিলামে চায়ের দাম বাড়বে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, স্থানীয় ভোক্তা তৈরির পাশাপাশি রপ্তানি না বাড়াতে পারলে চায়ের উৎপাদকেরাও টিকে থাকতে পারবেন না।

Tea 3

কী বলছে চা বোর্ড

চা বাগান বন্ধ ও নিম্নমানের চায়ের উৎপাদন সম্পর্কে জানতে চাইলে চা বোর্ডের সচিব (উপসচিব) মিনহাজুর রহমান বলেন, ২০২১ সালে বাগানগুলোর শ্রমিকদের মজুরি ৮ টাকা ৫০ পয়সা বেড়েছে। এটা অনেক বাগান মালিক হিমশিম খাচ্ছে বলে জানিয়েছে। এটা একটা বড় বিষয়। এটা নিয়ে প্রায় আলোচনা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের চায়ের ক্ষেত্রে কোয়ালিটি ঘাটতি রয়েছে। আসলে আর্থিক সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে, এটা একটা বড় বিষয়।

অন্যদিকে গুণগত চা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে উপপরিচালক (পরিকল্পনা) সুমন শিকদার বলেন, ভালো মানের চা উৎপাদনের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। বাগান মনিটরিং করি। বিভিন্ন পরামর্শ দেই। বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার করি। গুণগত মানের চায়ের উৎপাদনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চায়ের মানোন্নয়নের বিষয়টা বাগান মালিকদের হাতে। চা বোর্ড হাতে কলমে শিখিয়ে দেয়। তারা মান বাড়াতে পারলে নিলামে ভালো দাম পাবে।

সুমন শিকদার বলেন, নিলামে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম পেলে, তাদের গুণগত মান ভালো নয়। এর জন্য তাদেরকেই কাজ করতে হবে। পাতা চয়নের প্রক্রিয়ায় মনযোগ দিতে হবে, প্লাকিং রাউন্ড কমিয়ে আনতে হবে, ফ্যাক্টরি মেশিনারিজ স্থাপন করতে হবে। এভাবে তারা গুণগত মান বাড়াতে পারবে। এতে রপ্তানি করতে পারবে।

গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে রেকর্ড চা উৎপাদন হলেও ২০২৪ সালে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করছে চা বোর্ড। এ বিষয়ে সুমন শিকদার বলেন, ১০৮ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা। তবে এ বছর আমরা সেটা করতে পারব না। কারণ, এ বছর খরা, এনটিসির বাগানগুলো বন্ধ, পঞ্চগড়ে উৎপাদন কম। পঞ্চগড়ে মূল্য কমে যাওয়ায় সময়মতো পাতা চয়ন করেনি। এ জন্য উৎপাদন হয়েছে। এসব কারণে শেষ পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে।

চা শিল্পের মজুরি বিতর্ক

অন্য খাতের চেয়ে চা শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি কম নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। তবে এ খাতের মজুরির সঙ্গে অন্য খাতের তুলনা করা সঙ্গত নয় বলে মনে করে উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদ।

চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি রহমান বলেন, একমাত্র চা শিল্পেই মজুরি দেওয়া হয়— ইন ক্যাশ অ্যান্ড ইন কাইন্ড। ইন ক্যাশ যেটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা ১৭৮ টাকা বর্তমানে। ইন কাইন্ড আমরা রেশন ভর্তুকি দেই। চাল বা গম ২ টাকা কেজিতে দেওয়া হয়। একেকজন শ্রমিক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৪ কেজির মতো গম পায় প্রতি সপ্তাহে। তাদের ঘর আমরা তৈরি করি এবং মেইনটেইন করি। অন্য শিল্পে মেডিক্যাল সার্ভিস বলে কিছু নেই, কিছু টাকার অ্যালাউন্স আছে। আর চা শিল্পে শুধু শ্রমিক নয়, শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সবার জন্য মেডিক্যাল সেবা রয়েছে। তারা অবসর নিলে বা মারা গেলে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল একজনকে তাৎক্ষণিক চাকরি দেওয়া হয়।

কামরান আরও বলেন, একজন শ্রমিক অবসরের পর আজীবন রেশন পায়। শুধু তাই নয়, এই শিল্পে একইসঙ্গে পরিবারের অনেক সদস্য কাজ করতে পারে। পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারে। এটাকে অন্য শিল্পের সঙ্গে মেলালে হবে না। আলাদা করে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) কোষাধ্যক্ষ পরেশ কালিন্দি বলেন, মালিকপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের ‘ক্যাশ অ্যান্ড কাইন্ড’ দিচ্ছে। যেখানে ১৭৮ টাকা ক্যাশ এবং রেশন সাবসিডি, হাউজ ফ্যাসিলিটি, হেলথ ফ্যাসিলিটিসহ অন্য বিষয়কে তারা কাইন্ড বলে মোট মজুরি ৫৭০ টাকা বলছেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

তিনি বলেন, শ্রম আইনের ‘ধারা ২ এর দফা ৪৫(ক) অনুযায়ী বাসস্থান সংস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের মূল্য অথবা সরকার কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা বাদ দেওয়া হইয়াছে—এইরূপ কোনো সেবার মূল্য, মজুরির অর্ন্তভুক্ত হবে না।

Source link