চুয়াডাঙ্গা ০৯:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রমজানের অপেক্ষায় থাকতেন রসুল (সা.)

  • নিউজ রুমঃ
  • প্রকাশ : ০১:৩০:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩
  • 428

রজবের চাঁদ দেখার পরপরই রসুল (সা.) দোয়া পড়তেন ‘ওয়া বাল্লিগনা ইলা রামাদান! হে আল্লাহ! আমাদের জীবন রমজান পর্যন্ত দীর্ঘ করে দিন।’

দুই মাস আগে থেকে তিনি রমজানের অপেক্ষায় থাকতেন। আর রমজান এলে তাঁর ইবাদতে জোয়ার আসত।

 

আল্লাহ তায়ালা যতসব ইবাদত তাঁর মু’মিন বান্দাদের ওপর ফরজ করেছেন, এর পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। এ হিসেবে মু’মিনদের ওপর রোজা ফরজ করার পেছনেও রয়েছে আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য।

সব মুমিন বান্দায় আল্লাহর করুণায় সিক্ত। আর একদিন পরই আমাদের মধ্যে আসবে এক সম্মানিত মেহমান। মাহে রমজান। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া তিনি আমাদের আরেকটি রমজান যাপনের সৌভাগ্যের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

 

১. তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করা : রোজার প্রধান উদ্দেশ্য মু’মিনদেরকে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির গুণে গুণান্বিত করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।’ (সূরা আল বাকারা-১৮৩) এ আয়াতে রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ সতর্ক হওয়া, ভয় করা, সংযত হওয়া, বেঁচে থাকা, শক্তি সঞ্চয় করা, দায়িত্বশীল হওয়া, জবাবদিহিতার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করা। পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় সতর্ক ও সচেতনতার সাথে পরকালে আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার মনোভাব নিয়ে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে সব কাজ সম্পাদন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পরিপন্থী সব কাজ বর্জন করা। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য হলো ছয়টি। যেমন- ১. সত্যের সন্ধান; ২. সত্য গ্রহণ; ৩. সত্যের ওপর অটল থাকা; ৪. আল্লাহভীতি; ৫. দায়িত্বানুভূতি; ৬. জবাবদিহিভিত্তিক দায়িত্বশীলতার সাথে কর্তব্য সম্পাদন।

 

২. জৈবিক চাহিদা থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা : জৈবিক চাহিদা মানবের সবচেয়ে ক্ষতিকর জিনিস। এর থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, সিয়ামের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক বাসনা ও জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত রাখা, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার শৈলচূড়ায় আরোহণ করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। সিয়াম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক সৃষ্টি করে মানুষের শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে এবং পাশবিক চাহিদা যা মানুষের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে তা থেকে মুক্ত করে। অনুরূপ রোজা কলবের ইসলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে (জাদুলমাআদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫২) শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহ: হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে বলেছেন, রোজার উদ্দেশ্য হলো মানুষ থেকে পশু স্বভাব দূর করা। পশু স্বভাব মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। তাই মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অর্থাভাবে বিয়ে করতে অক্ষম সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ, সিয়াম পালনের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিয়ে করার কামনা দূর হবে।’ (মিশকাত বিয়ে পর্ব, পৃষ্ঠা- ২৬৭)

 

৩. আত্মিক ও দৈহিক ফায়দা : দৈহিক উৎকর্ষ সাধনে রোজার ভূমিকা অন্যতম। সিয়াম সাধনায় যেমন আত্মিক পরিচ্ছন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে দৈহিক সুস্থতা। অধ্যক্ষ ডাক্তার বি সি গুপ্ত বলেছেন, ইসলাম সিয়াম সাধনার যে বৈজ্ঞানিক নির্দেশ দিয়েছে, তা যে মানুষের দৈহিক ও আত্মিক মঙ্গল সাধনে সক্ষম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ডাক্তার আর ক্যামবারড বলেছেন, সিয়াম পরিপক্ব শক্তির সহায়ক। ডক্টর এমারসন বলেন, যদি কারো স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য উপবাসের প্রয়োজন হয়, তবে সে যেন ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রোজা পালন করে। অতএব এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, সিয়াম সাধনায় অর্জিত হয় দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার ফায়দা।

 

৪. ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা দান : সিয়াম সাধনায় রয়েছে সিয়াম পালনকারীর জন্য ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা। রোজা পালনের ফলে আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের মহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রোজাদারের দৈহিক, আত্মিক ও মানসিক অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়। নিজে জঠরজ্বালা সহ্য করে এবং সমাজের গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন, যারা উপবাসে দিন কাটায়, তাদের অবস্থা অনুভব করে। তাই রমজান মাসকে বলা হয় ধৈর্য ও সহমর্মীর মাস।

 

৫. রিপগুলো দমন করা : সিয়াম সাধনা রিপুগুলো দমন করে এবং আত্মার লালসা দূরীভূত করে মু’মিনের দেহ ও মনে পরিচ্ছন্নতা আনয়ন করে। ফলে সিয়াম সাধনা আত্মশুদ্ধির অন্যতম সুযোগ। সিয়াম রিপুগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে মুত্তাকি হওয়ার পরম সুযোগ করে দেয়। সিয়াম সাধনা অনর্থক কাজ, মিথ্যা বচন, প্রবঞ্চনা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, অসৎকর্ম, কর্কশবাক্য ব্যবহার ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখে। মহানবী সা: বলেন, পাঁচটি জিনিসকে সিয়াম নষ্ট করে দেয়। তা হলো- মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কূটনামি, মিথ্যা শপথ ও কামভাবে দৃষ্টিপাত। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ করা ছাড়তে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ তথা রোজা রাখা আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি-১৭৭০)

 

৬. আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনা মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করে। ইমাম গাজ্জালি রহ: ‘ইয়াহইয়াউল উলুম’ গ্রন্থে বলেছেন, আখলাকে ইলাহির গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে তোলাই সিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা পানাহার করেন না। রোজাদার পানাহার বর্জনের ফলে আখলাকে ইলাহির গুণে গুণান্বিত হয়।

৭. ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত হয়। ফেরেশতারা যেমন পানাহার করে না, রোজাদারও পানাহার করে না। ফলে পানাহার ও কামাচার বর্জনের দিক দিয়ে ফেরেশতা ও রোজাদার সমগুণে গুণান্বিত হয়। রোজাদারদের মর্যাদা এই যে, তার মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মৃগনাভির সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ (মুসলিম-১৯৪৫)

 

৮. নফসকে বিবেকের শাসন মানতে বাধ্য করা : মানবদেহের মূল অঙ্গ হলো নফস বা আত্মা। এই আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মন্দ চিন্তা থেকে মুক্ত রাখার একমাত্র পন্থা হলো রোজা রাখা। নফস বা প্রবৃত্তিকে বিবেকের শাসন মানতে অভ্যস্ত করে তোলাই রোজার বিশেষ উদ্দেশ্য। প্রবৃত্তি ও বিবেক এই দুয়ের জয়-পরাজয় নিয়েই মানুষের মধ্যে পশুত্ব ও সততার জয়-পরাজয় সূচিত হয়ে থাকে। আর সিয়াম পালনের মাধ্যমেই ব্যক্তি পশুত্বের ওপর সততা ও অন্যায়ের ওপর ন্যায় বিজয়ী হয়। অন্য কোনো ইবাদতে তা সম্ভব নয়।

৯. পাপমুক্ত রাখা : সিয়াম সাধনা নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। হজরত জিবরাঈল আ: দোয়া করেছেন, আর মহানবী সা: আমিন বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক (আদারুল মুদরাবাদ, ইমাম বুখারি) এ দোয়া কখনো বিফলে যাবে না। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে দোয়া কবুল হয়। বিশেষ করে ইফতারের সময়, শেষ রাতে, কদরের রাতে, জুমার দিনে। এ মাসের দানে ৭০০ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। একটি নফল আদায় করলে ফরজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা নিজে সিয়াম পালনকারীর প্রতিদান দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। (মুসলিম-১৯৪৫) জান্নাতের একটি দরজার নাম রাইয়ান, যা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের। অতএব, সব দিক বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়, নিজেকে পাপমুক্ত রাখার এবং অধিক পুণ্য লাভের মুখ্য সময় হলো এ মাহে রমজান।

 

১০. অনুপম ইবাদত : রোজা একটি অনুপম ইবাদত। তা দীর্ঘ সময় ধরে পালন করতে হয়। এ মাসে কুরআনসহ সব আসমানি গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, সব উম্মতের ওপর তা ফরজ এবং তা লৌকিকতামুক্ত ইবাদত।

জনপ্রিয় সংবাদ
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

রমজানের অপেক্ষায় থাকতেন রসুল (সা.)

প্রকাশ : ০১:৩০:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩

রজবের চাঁদ দেখার পরপরই রসুল (সা.) দোয়া পড়তেন ‘ওয়া বাল্লিগনা ইলা রামাদান! হে আল্লাহ! আমাদের জীবন রমজান পর্যন্ত দীর্ঘ করে দিন।’

দুই মাস আগে থেকে তিনি রমজানের অপেক্ষায় থাকতেন। আর রমজান এলে তাঁর ইবাদতে জোয়ার আসত।

 

আল্লাহ তায়ালা যতসব ইবাদত তাঁর মু’মিন বান্দাদের ওপর ফরজ করেছেন, এর পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। এ হিসেবে মু’মিনদের ওপর রোজা ফরজ করার পেছনেও রয়েছে আল্লাহর মহান উদ্দেশ্য।

সব মুমিন বান্দায় আল্লাহর করুণায় সিক্ত। আর একদিন পরই আমাদের মধ্যে আসবে এক সম্মানিত মেহমান। মাহে রমজান। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া তিনি আমাদের আরেকটি রমজান যাপনের সৌভাগ্যের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

 

১. তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করা : রোজার প্রধান উদ্দেশ্য মু’মিনদেরকে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির গুণে গুণান্বিত করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।’ (সূরা আল বাকারা-১৮৩) এ আয়াতে রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ সতর্ক হওয়া, ভয় করা, সংযত হওয়া, বেঁচে থাকা, শক্তি সঞ্চয় করা, দায়িত্বশীল হওয়া, জবাবদিহিতার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করা। পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় সতর্ক ও সচেতনতার সাথে পরকালে আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার মনোভাব নিয়ে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে সব কাজ সম্পাদন করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পরিপন্থী সব কাজ বর্জন করা। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য হলো ছয়টি। যেমন- ১. সত্যের সন্ধান; ২. সত্য গ্রহণ; ৩. সত্যের ওপর অটল থাকা; ৪. আল্লাহভীতি; ৫. দায়িত্বানুভূতি; ৬. জবাবদিহিভিত্তিক দায়িত্বশীলতার সাথে কর্তব্য সম্পাদন।

 

২. জৈবিক চাহিদা থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা : জৈবিক চাহিদা মানবের সবচেয়ে ক্ষতিকর জিনিস। এর থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখা রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, সিয়ামের বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক বাসনা ও জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত রাখা, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার শৈলচূড়ায় আরোহণ করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। সিয়াম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক সৃষ্টি করে মানুষের শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে এবং পাশবিক চাহিদা যা মানুষের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে তা থেকে মুক্ত করে। অনুরূপ রোজা কলবের ইসলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে (জাদুলমাআদ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫২) শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহ: হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে বলেছেন, রোজার উদ্দেশ্য হলো মানুষ থেকে পশু স্বভাব দূর করা। পশু স্বভাব মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। তাই মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অর্থাভাবে বিয়ে করতে অক্ষম সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ, সিয়াম পালনের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিয়ে করার কামনা দূর হবে।’ (মিশকাত বিয়ে পর্ব, পৃষ্ঠা- ২৬৭)

 

৩. আত্মিক ও দৈহিক ফায়দা : দৈহিক উৎকর্ষ সাধনে রোজার ভূমিকা অন্যতম। সিয়াম সাধনায় যেমন আত্মিক পরিচ্ছন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে দৈহিক সুস্থতা। অধ্যক্ষ ডাক্তার বি সি গুপ্ত বলেছেন, ইসলাম সিয়াম সাধনার যে বৈজ্ঞানিক নির্দেশ দিয়েছে, তা যে মানুষের দৈহিক ও আত্মিক মঙ্গল সাধনে সক্ষম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ডাক্তার আর ক্যামবারড বলেছেন, সিয়াম পরিপক্ব শক্তির সহায়ক। ডক্টর এমারসন বলেন, যদি কারো স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য উপবাসের প্রয়োজন হয়, তবে সে যেন ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী রোজা পালন করে। অতএব এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, সিয়াম সাধনায় অর্জিত হয় দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার ফায়দা।

 

৪. ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা দান : সিয়াম সাধনায় রয়েছে সিয়াম পালনকারীর জন্য ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা। রোজা পালনের ফলে আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের মহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রোজাদারের দৈহিক, আত্মিক ও মানসিক অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়। নিজে জঠরজ্বালা সহ্য করে এবং সমাজের গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন, যারা উপবাসে দিন কাটায়, তাদের অবস্থা অনুভব করে। তাই রমজান মাসকে বলা হয় ধৈর্য ও সহমর্মীর মাস।

 

৫. রিপগুলো দমন করা : সিয়াম সাধনা রিপুগুলো দমন করে এবং আত্মার লালসা দূরীভূত করে মু’মিনের দেহ ও মনে পরিচ্ছন্নতা আনয়ন করে। ফলে সিয়াম সাধনা আত্মশুদ্ধির অন্যতম সুযোগ। সিয়াম রিপুগুলো পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে মুত্তাকি হওয়ার পরম সুযোগ করে দেয়। সিয়াম সাধনা অনর্থক কাজ, মিথ্যা বচন, প্রবঞ্চনা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, অসৎকর্ম, কর্কশবাক্য ব্যবহার ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখে। মহানবী সা: বলেন, পাঁচটি জিনিসকে সিয়াম নষ্ট করে দেয়। তা হলো- মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কূটনামি, মিথ্যা শপথ ও কামভাবে দৃষ্টিপাত। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ করা ছাড়তে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ তথা রোজা রাখা আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি-১৭৭০)

 

৬. আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনা মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করে। ইমাম গাজ্জালি রহ: ‘ইয়াহইয়াউল উলুম’ গ্রন্থে বলেছেন, আখলাকে ইলাহির গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে তোলাই সিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা পানাহার করেন না। রোজাদার পানাহার বর্জনের ফলে আখলাকে ইলাহির গুণে গুণান্বিত হয়।

৭. ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত করা : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত হয়। ফেরেশতারা যেমন পানাহার করে না, রোজাদারও পানাহার করে না। ফলে পানাহার ও কামাচার বর্জনের দিক দিয়ে ফেরেশতা ও রোজাদার সমগুণে গুণান্বিত হয়। রোজাদারদের মর্যাদা এই যে, তার মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মৃগনাভির সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ (মুসলিম-১৯৪৫)

 

৮. নফসকে বিবেকের শাসন মানতে বাধ্য করা : মানবদেহের মূল অঙ্গ হলো নফস বা আত্মা। এই আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মন্দ চিন্তা থেকে মুক্ত রাখার একমাত্র পন্থা হলো রোজা রাখা। নফস বা প্রবৃত্তিকে বিবেকের শাসন মানতে অভ্যস্ত করে তোলাই রোজার বিশেষ উদ্দেশ্য। প্রবৃত্তি ও বিবেক এই দুয়ের জয়-পরাজয় নিয়েই মানুষের মধ্যে পশুত্ব ও সততার জয়-পরাজয় সূচিত হয়ে থাকে। আর সিয়াম পালনের মাধ্যমেই ব্যক্তি পশুত্বের ওপর সততা ও অন্যায়ের ওপর ন্যায় বিজয়ী হয়। অন্য কোনো ইবাদতে তা সম্ভব নয়।

৯. পাপমুক্ত রাখা : সিয়াম সাধনা নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। হজরত জিবরাঈল আ: দোয়া করেছেন, আর মহানবী সা: আমিন বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক (আদারুল মুদরাবাদ, ইমাম বুখারি) এ দোয়া কখনো বিফলে যাবে না। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে দোয়া কবুল হয়। বিশেষ করে ইফতারের সময়, শেষ রাতে, কদরের রাতে, জুমার দিনে। এ মাসের দানে ৭০০ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। একটি নফল আদায় করলে ফরজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা নিজে সিয়াম পালনকারীর প্রতিদান দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। (মুসলিম-১৯৪৫) জান্নাতের একটি দরজার নাম রাইয়ান, যা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, মধ্য ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের। অতএব, সব দিক বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়, নিজেকে পাপমুক্ত রাখার এবং অধিক পুণ্য লাভের মুখ্য সময় হলো এ মাহে রমজান।

 

১০. অনুপম ইবাদত : রোজা একটি অনুপম ইবাদত। তা দীর্ঘ সময় ধরে পালন করতে হয়। এ মাসে কুরআনসহ সব আসমানি গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, সব উম্মতের ওপর তা ফরজ এবং তা লৌকিকতামুক্ত ইবাদত।