ঢাকা মহানগরীতে জনদুর্ভোগ নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বহুবিধ আন্দেলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি, সেই সঙ্গে নাগরিক জীবনের কিছু অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা দুর্ভোগ বাড়িয়েই চলেছে৷
রাজধানীতে সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেললাইন অবরোধও চলছে। যানজটের এই শহরে কোনো একটি সড়ক অবরোধ করলে তার প্রভাব পড়ে অন্য সড়কগুলোতেও। ফলে যানজট এমনভাবে বেড়ে যাচ্ছে যে চলাফেরাই দায় হয়ে পড়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, “স্বাধীনতা মানে কি যা ইচ্ছে তা-ই করা? অন্যের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা? এখন তো মনে হচ্ছে স্বাধীনতা মানেই সড়ক অবরোধ, রেলপথ অবরোধ। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, ‘আমার ক্ষমতা আছে, ফলে আমি যা খুশি তা-ই করতে পারি।’ পরিস্থিতি এখন অনাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। পরষ্পর পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ থাকাটা জরুরি। সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশেই দাবি জানানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে। রাজনৈতিক দাবি হোক আর সামাজিক দাবি হোক- সবাই সেখানে গিয়ে দাবি জানান। এখানেও সেরকম নির্দিষ্ট জায়গা করে দেওয়া দরকার। সেই জায়গা কিন্তু আমাদের আছে। চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের আন্দোলন হতে পারে না। নব্বইয়ের দশকের শেষে দিকে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের যে রেওয়াজ চালু হয়েছে, এখনো সেটা চলছে। এই অবস্থার নিরসন দরকার।”
কোনো ধরনের পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সড়কে নেমে অবরোধ শুরু করেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকেরা। সকাল ৯টা থেকে বেলা সোয়া ৩টা পর্যন্ত, অর্থাৎ ৬ ঘণ্টা ধরে মহাখালী রেলক্রসিং অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে তারা রাজধানীর গুলশান, খিলগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ নম্বর, বাড্ডা ও মেরাদিয়া এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
হাইকোর্ট গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপের নির্দেশ দেন। ওই দিন রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় আফসানা করিম নামের এক ছাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। তারা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের দাবি জানান। এদিকে ঢাকায় যখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন, তখন এটা বন্ধের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন।
প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ী ইমরুল হাসান বলেন, “সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে আগারগাঁওয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের অবরোধের মধ্যে পড়েছি। ফলে অনেকদূর ঘুরে ইস্টার্নপ্লাজার অফিসে আসতে হয়েছে। সরকারকে আসলে এসব ব্যাপারে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও শক্ত হতে হবে। এমনিতেই তো যানজটের কারণে ঢাকা শহরে চলাফেরা করা মুশকিল। ফুটপাতে হাঁটা যায় না। অগ্নিমূল্যের কারণে বাজারে গিয়ে সবজি কেনা যায় না। তাহলে এই শহরের মানুষ যাবে কোথায়?”
ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ, বুধবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই দিন বেলা পৌনে ৩টার দিকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোতে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের একটি বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে সিটি কলেজের কয়েকজ শিক্ষার্থীর হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে সকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা গিয়ে সিটি কলেজে ভাঙচুর চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তারা সায়েন্স ল্যাবের দিকে এগিয়ে যায়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও বেরিয়ে এসে সায়েন্স ল্যাবের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হলে এলাকাটি একরকম রণক্ষেত্রের রূপ নেয়।
গত রোববার লটারি নয়, মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ভর্তির দাবিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। আসাদগেট থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও অবশ্য দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সড়ক ছেড়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রুবাইদ হোসেন বলেন, “আমার বাসা মিরপুর-১০ নম্বরে। মেয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের গ্রিনহেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। তার ক্লাস ছুটি হয় ১২টায়। রবিবার মেয়েকে স্কুলে আনতে গিয়ে রেসিডেন্সিয়ালের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে পথে আটকে যায়। স্কুলে পৌঁছতে ১টা বেজে যায়। দেরি হওয়ার কারণে মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্বর এসে গেছে। অথচ বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এভাবে যদি কথায় কথায় সবাই সড়ক অবরোধ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে চলবেন? দুইটায় আমার হাসপাতালের ডিউটিতে যোগ দেওয়ার কথা। সেখানে যেতে সাড়ে ৩টা বেজে গেছে। প্রতিনিয়তই আমরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ রাস্তায় নেমে দাবি জানাচ্ছেন। চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে কয়েকদিন আগে হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তাদের দাবির মুখে চাকরিতে যোগ দেয়ার সর্বোচ্চ বয়স ৩২ বছর করা হয়। এরপর সচিবালয় ঘেরাও করে ৭ দফা দাবি জানায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি বাস্তবায়নে কমিটি করা হয়েছে।
এছাড়া সোমবার সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ তিনদফা দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে দিনভর আন্দোলন করেছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। এতে মহাখালী থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা। অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা হন। আন্দোলন চলাকালে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তঃনগর ট্রেন ‘উপকূল এক্সপ্রেস’ মহাখালীতে পৌঁছলে চলন্ত ট্রেনে আন্দোলনকারীরা হামলা-ভাঙচুর চালায়। এতে শিশুসহ অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন। পরে তাদের দাবি পর্যালোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রনালয়।
রাজধানীর সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নের উপায় জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “বর্তমান সরকারের সময়ে দাবি-দাওয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। সবাই যে যৌক্তিক দাবি করছে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু সরকার যদি দাবি মেনে নেয়, তাহলে তো এটা বাড়তেই থাকবে। এই সরকার হয়ত রাজনৈতিক সরকারের মতো শক্ত হতে পারবে না, কিন্তু কিছুটা শক্ত তো হতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনেই তো এই সরকার হয়েছে, ফলে সরকারকে এলাকাভিত্তিক মানুষকে সম্পৃক্ত করে কিছু কমিটি করতে হবে, যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে সহযোগিতা করবে, পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে যত দ্রুত সম্ভব একটা কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করাতে হবে।”
তবে এক্ষুনি সরকারের শক্ত অবস্থানের পক্ষে নন অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি বলেন, “গত ১৫ বছর যারা কথা বলতে পারেনি, এখন তারা কথা বলছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন কথা বলেননি কেন? তারা তো কথা বলতে পারেনি, বলতে গেলেই তাদের গুম-খুন হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বলতে যে পারেনি, এই কারণেই তো জুলাইয়ের আন্দোলনে তারা অংশ নিয়েছে। ফলে এই সরকারের পক্ষে শক্ত হওয়া মুশকিল। এখন যারা দাবি করছে, তাদের অন্তত গুম-খুন হওয়ার ভয় নেই। ফলে তারা কথা বলার সাহস পাচ্ছেন। নির্বাচন যত এদিয়ে আসবে, এই দাবি হয়ত আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতির উত্তরণে সরকারের শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই। আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি