চতুর্থ প্রজন্মের বিমা কোম্পানি জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম নুরুজ্জামান। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করলেও নিজ মেধা, পরিশ্রম ও যোগ্যতায় তিনি এখন কোম্পানিটির শীর্ষ পদে রয়েছেন। দেশের বিমা খাতের বর্তমান অবস্থা, আস্থার সংকট, সুশাসনসহ নানা বিষয়ে ‘হ্যালো বাংলাদেশ’র সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন।
জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে জানতে চাই।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বর্তমানে আমাদের মোট শাখা ৭০টি। চলতি বছর ১০০টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিমাসহ আমাদের অনেকগুলো ভালো সেবা পণ্য রয়েছে। গত বছর নানা প্রতিবদ্ধকতার পরও আমাদের কোম্পানির ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসা বিনিয়োগ ও বিমা দাবি নিস্পত্তিতে যথেষ্ট সাফল্য রয়েছে। ২০২৪ সালে জেনিথ লাইফ ৯৮ দশমিক ১৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। ইআরপি সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমরা অনলাইনে বিমা দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে থাকি। আমরা এককভাবে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি। যেটি এককভাবে কোনো কোম্পানি করে না। আমাদের বাংলায় ওয়েবসাইট ও অ্যাপস রয়েছে।
বিমা খাতের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
গত ৫ আগস্টের পর বিমা খাতে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাংক খাতে সংস্কার হলো। ব্যাংকের পাশাপাশি বিমা খাতকেও সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসা দরকার ছিলো। যে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের টাকা দিতে পারলো না, সরকার তাদের ছেপে টাকা দিলো। বিমা খাতের ১১ লাখ গ্রাহক টাকা পায়নি, তাদের ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা আছে। বিমা কোম্পানিতে টাকা রেখে টাকা ফেরত পাবে – যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এ ম্যাসেজটা না পাবে, ততক্ষন বিমা খাতে ইমেজ বা আস্থা সংকট কাটবে না। সরকার কোম্পানিগুলোকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে অথবা সরকার নিজে দিয়ে হোক। অন্যথায় বিমা খাতের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
দেশের অর্থনীতি যতটা এগিয়েছে, বিমা খাত সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসেও বিমা খাত কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে আসতে না পারার কারণ কি- এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?
এটার মূল কারণ হচ্ছে আস্থার সংকট। বিমা হচ্ছে আস্থার জায়গা। সেটা আমরা করতে পারিনি। দ্বিতীয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে এসে ডিগ্রীধারীরা পেশা হিসেবে বিমাকে নিচ্ছে না। এটা তাদের লক্ষ্য থাকে না। ৫ আগস্টের আগে সব বিমা কোম্পানির সঙ্গে এমপি, মন্ত্রী, সরকারের বা দলীয় পর্যায়ের নেতারা জড়িত ছিলো। ৫ আগস্টের পরে সরকার চাইলে বিমা খাতে বড় পরিবর্তন করা যেতো। আবার যখন রাজনৈতিক সরকার আসবে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিমা খাত অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করে বিমা মানে এমএলএম প্রতিষ্ঠান, ডেসটিনি বা মাল্টি লেভেল কোম্পানি। কিন্তু বিমা খাতে একটা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইন আছে। আমারা এ বিষয়গুলো গ্রাহকের কাছে সেভাবে উপস্থাপন করতে পারিনা।
বিমা খাতে আস্থার সংকট কাটাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
আস্থার সংকট কাটাতে হলে প্রথমত এ খাতকে অবশ্যই ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। সব বিমা কোম্পানিকে আইটি ভিত্তিক হতে হবে। নিজস্ব ইআরপি থাকতে হবে। গ্রাহকের বিমা দাবি দ্রুত নিস্পত্তি করতে হবে। ক্লেম পাওয়ার জন্য নতুন ব্যাংক হিসাব করাসহ গ্রাহকদের কোনো হয়রানি করা যাবে না। গ্রাহকের বিমার টাকা তার মোবাইল একাউন্ট এ দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে ম্যাচিউরিটির টাকা তিন কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়া সম্ভব। এখন বাংলাদেশে বিমা খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা ১১ লাখ গ্রাহকের বিমা দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা। এটা হয়েছে বিমার টাকা তছরুপের কারণে। বিভিন্ন বিমা কোম্পানিতে নানা কৌশলে টাকা লুটপাট হয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই মানুষের স্বাস্থ্যসেবাসহ সার্বিক জীবন ব্যবস্থা বিমা পলিসির আওতায় রয়েছে। আমরা এ অবস্থানে কেন যেতে পারছি না?
করোনার পর স্বাস্থ্য বিমার গুরুত্ব বেড়েছে। দেশের সব কোম্পানি স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে কাজ করে না। যদিও মানুষের কাছে স্বাস্থ্য বিমার অনেক গ্রহনযোগ্যতা আছে। আমার প্রথম গ্রুপে স্বাস্থ্য বিমা দিয়ে দেখলাম। জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কাজ করছে। রাজশাহীতে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে আমরা স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনার জন্য কাজ করছি। আমরা যদি এ খাতে যুগপোযোগী সেবা পণ্য নিয়ে আসতে পারি তাহলে পাশের দেশের মতো এখানেও স্বাস্থ্য বিমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।
পিছিয়ে থাকা বীমা কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) হচ্ছে বিমা খাতে অভিভাবক। বিমা কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যে কোম্পানিগুলো বিমা দাবি নিস্পত্তি করছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে । অনেক কোম্পানি গ্রাহকদের জোর করে পলিসি করাচ্ছে এবং নানা কুটকৌশল অবলম্বন করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এদিকে ৯০ শতাংশই ফোকাস দেওয়া দরকার। বিমা খাতে মূল সমস্যা দুটি – লাইফ ও নন-লাইফ। জীবন বিমায় ক্ল্যাম সেটেলমেন্ট (দাবি নিস্পত্তি) এবং নন-লাইফে অতিরিক্ত কমিশন। এ দুটি সমস্যা দূর করলে বিমা খাতে বড় পরিবর্তন আসবে।
২০২৪ সালে জেনিথ লাইফ প্রায় শতভাগ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। ভবিষতে গ্রাহকের বিমা দাবি পূরণ ও সেবা বাড়াতে আপনাদের পদক্ষেপগুলো জানতে চাই।
২০২৪ সালে শুরুতে জেনিথ লাইফের অনিষ্পন্ন বিমা দাবি ছিল সর্বমোট ৫৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮১৬ টাকা। ২০২৪ সালে নতুন করে বিমা দাবি উত্থাপিত হয় ৭ কোটি ৮ লাখ ৪ হাজার ৯৪৭ টাকা। এ বছর আমাদের কোম্পানি গ্রাহকের ৭ কোটি ৫৩ লাখ ১৪ হাজার ১৫৫ টাকা পরিশোধ করেছে, যা মোট বিমা দাবির ৯৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোট উত্থাপিত বিমা দাবির ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৮ টাকা অনিষ্পন্ন রয়েছে।
জেনিথ লাইফ দাবি-সংক্রান্ত নথিপত্র সঠিক থাকলে সর্বোচ্চ সাত কার্যদিবসের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করে থাকে। এ ছাড়া, বিমা দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ইআরপি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনলাইনে দাবি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের পাশাপাশি বিইএফটিএন এবং এমএফএসের মাধ্যমেও দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে গ্রাহকরা দ্রুত বিমা দাবির টাকা পেয়ে যাচ্ছেন।
জেনিথ ইসলামী লাইফের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
কোম্পানি বড় হতে হবে, ব্যবসা অনেক প্রসার হবে – আমরা সে রকম চিন্তা করিনা। আমাদের মটো হচ্ছে গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা যত দ্রুত সম্ভব তাদের হাতে ফেরত দেওয়া। গ্রাহকের যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয়- এ বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের কমিটমেন্ট হচ্ছে সাত কর্মদিবসের মধ্যে সব বিমা দাবি নিস্পত্তি করা। চতুর্থ প্রজন্মে যেসব বিমা কোম্পানি বাজারে রয়েছে তাদের মধ্যে আমরা প্রথম তিনটির মধ্যে থাকতে চাই। বেকারত্ব বিমোচন ও কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করতে চাই। আমাদের কোম্পানি থেকে গ্রাহকরা যাতে ভালো ডেভিডেন্ট ও উন্নত সেবা পায় সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।