চুয়াডাঙ্গা ১২:১৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছবি গপ্পো: বাবা-মায়ের জন্য যে বার্তা দিল জনপ্রিয় সিরিজ ‘এডোলেসেন্স’


২০২৫ এর ১৩ মার্চ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলো মিনি সিরিজ ‘এডোলেসেন্স’ (কৈশোর)। চার পর্বের এই সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে এক মর্মস্পর্শী আখ্যান, যেখানে ১৩ বছর বয়সী জেমি মিলারের নিষ্পাপ শৈশব কীভাবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে গড়িয়ে যায়। প্রতিটি পর্ব প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ, তবে এটি কোনো সাধারণ ক্রাইম থ্রিলার নয়। বরং সিরিজটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের নিয়ে যায় কিশোর মনের জটিল এক জগতে। জেমি কীভাবে তারই স্কুলের সহপাঠী কেটিকে হত্যা করল, তার পেছনের কারণ কী, সেই গল্প বলার ভঙ্গিটিই এই সিরিজের প্রধান শক্তি।

চারটি পর্বের প্রথমটিতে দেখা যায়, জেমিকে এরেস্ট করা থেকে শুরু করে থানায় কীভাবে আইনি উপায়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে দেখা যায়, জেমির স্কুলে ইনভেস্টিগেশনের নানা ধাপ। তৃতীয় পর্বে দেখা যায়, পুলিশি হেফাজতে থাকা জেমির সাথে একজন মনোবিজ্ঞানীর কথোপকথন। এবং শেষ পর্বে জেমির পরিবারের ভোগান্তি ও অপরাধবোধের কাব্য। এই গল্পগুলো শক্তভাবে ফুটে উঠেছে কেননা সিঙ্গেল-টেকে প্রতিটা পর্ব শ্যুট করা হয়েছে। এজন্য থানা, স্কুল, ইনভেস্টিগেশন রুম, জেমির পরিবারের চরিত্রগুলো  এতটাই নিরপেক্ষ এবং নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে যা বাস্তবতার কাছাকাছি।   

সাইবার ব্যুলিং ও কিশোর অপরাধ এখন এক আলোচনার বিষয় সেখানে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের জন্য ‘এডোলেসেন্স’ অনেক বড় একটা শিক্ষা। মূলত কৈশোর থেকেই একটা জেনারেশনের বিভাজন তৈরি হতে থাকে। দুঃখজনক হলেও কৈশোরের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং সামাজিক বিধিনিষেধ ও কামনাবোধ সেখানে লড়াইটা তাদের একা একা করতে হয়। এ কারণে দূরত্ব ও লুকোচুরি তৈরি হয় বাবা-মায়ের সাথে। প্রতিটি জেনারেশনই তার চেয়ে পরের জেনারেশনকে অনেক চালাক মনে করে। আসলে তারা নিজ নিজ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সিরিজে সেই কৈশোর দেখানো হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি ও নগর সংস্কৃতি আমাদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে ক্রমাগত খেলা করে চলেছে। এই খেলার ভয়ানক পরিণতি হিসেবে পরিচালক দেখিয়েছেন মানসিক ও সামাজিক বিকৃতি। এই ঘোর বিপদ কি আমরা টের পাচ্ছি? 

সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে যখন ডিটেক্টিভ জেমির স্কুলে যান তদন্তের জন্য তখন ডিস্তার্বড একদল কিশোর-কিশোরীদের দেখতে পান। স্কুলে জনপ্রিয় হওয়া, সুন্দর হওয়া, একজন সঙ্গী পাওয়া, পড়ালেখায় ভালো হওয়া, ধনী ঘর থেকে আসা, খেলাধুলা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডে ভালো হওয়া শিক্ষার্থীরা উঁচু শ্রেণিতে পড়ে। বাকিরা পড়ে নিচু শ্রেণিতে। সাধারণত সুবিধাজনক অবস্থানে যারা থাকে তারা বাকিদের হেনস্তা করে। আর সুবিধাবঞ্চিতদের মনে তীব্র বাসনা থাকে অপর দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। এই কারণে তাদের মাঝে তৈরি হয় প্রবল ঘৃণা ও কামনার এক জটিল প্রক্রিয়া। খেয়াল করলে দেখবেন এই বাস্তবতা আমাদের সমাজেও উপস্থিত। 

2 copy

নাবালক হওয়ায় বাবার সাথে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিচ্ছে জেমি। ছবি: ইন্টারনেট

জেমি মূলত ছিল সুবিধাবঞ্চিতের দলে, আর কেটি সুবিধাবানদের দলে। জেমির ইন্সটাগ্রাম একাউন্টে কেটি তাকে হেনস্তা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। ইমোজির ভাষায় অহরহ ঘটতে থাকা এই প্রসঙ্গগুলো বাবা-মা বুঝতে পারবেননা। এনিয়ে জেমির ক্ষোভ থাকলেও সে মনে মনে কেটিকে কামনা করত। কেটির ব্যক্তিগত ছবি স্কুলে ভাইরাল হয়ে যায়। তখন কেটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জেমি ভাবে এই দুর্বলতার মুহূর্তে প্রেম নিবেদন করলে হয়তো কেটি তার কথা শুনবে। কিন্তু তা হয় না, বরং কেটি বেশ ক্ষিপ্ত হয়। জেমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। প্রত্যাখ্যাত হলে কেটি আবারো সামাজিক মাধ্যমে তাকে হেনস্তা করতে পারে এটা তার জানা।

তাই সে তার বন্ধুর বাড়ির রান্নাঘর থেকে আনা চাকু দিয়ে সাতবার কেটিকে আঘাত করে মেরে ফেলে। পরবর্তীতে যখন মনোবিজ্ঞানীর সাথে জেমি কথা বলে তখন এই ঘটনায় হত্যার প্রসঙ্গটি স্বীকার না করলেও কেটির দেহের কোনো অংশ যে সে স্পর্শ করেনি এটা বারবার বলছিল। যেন এইজন্য সে বাহবা পাওয়ার যোগ্য। সে ধর্ষন করেনি, নিপীড়ন করেনি যা সে করতে পারতো। এই দাবীর মধ্য দিয়ে নারীবিদ্বেষের এমন সূক্ষ্মভাব টের পাওয়া যায় যা দর্শকরাও হয়তো বুঝতে পারতেননা যদিনা দৃশ্যে থাকা মনোবিজ্ঞানী একজন নারী না হতেন। প্রাপ্তবয়স্ক পেশাদার একজন মনোবিজ্ঞানীও যেন নিজেকে খুব কষ্ট করে ধরে রেখেছেন কেননা জেমি রাগে ফেটে পড়ছিল। কোথা থেকে আসে এত রাগ? 

ঘটনা অতি সামান্য। কাউকে হত্যা করার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু কৈশোরে ঐটাই তাদের দুনিয়া। ডিভাইসে আসক্ত শিশুদের দুনিয়া ভয়ানক সীমিত। জেমির বাবা-মা বার বার নিজেদের ভুল খোঁজার চেষ্টা করেন। ছেলেকে কোথায় ভুল শিক্ষা দিলেন যে আজ এইদিন তাদের দেখতে হচ্ছে। ছেলের প্রতি তাদের কোনো ঘৃণা নেই। অতটুকু ছোটমুখ দেখলে কারোরই ঘৃণা আসবে না। কিন্তু বাড়িতে এমন কোনো পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করা হয়নি যে সে একজন খুনি হয়ে উঠবে।

বাড়িতে তার কোনো চাওয়া পাওয়াও পিতামাতা অপূর্ণ রাখেনি যে সে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে করবে। ভালোমানের কম্পিউটার ও গেমিং এর সরঞ্জাম তার আছে। জেমির বড় বোন খুব স্বাভাবিক আর পাঁচটা কিশোরীর মতই আচরণ করে। তার আচরণে কেউ বুঝতেও পারবেনা যে তার ভাই খুনি হতে পারে। অর্থাৎ জেমির খুনি হয়ে ওঠার পিছনে তার পারিবারিক আবহকে এককভাবে দায়ী করা যাচ্ছে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে ছেলের জীবনে কি চলছে, সে কি নিয়ে মনে মনে চাপবোধ করছে এগুলো সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেননা। 

a2

পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন জেমির সাথে মনোবিজ্ঞানীর আলাপচারিতার একটি দৃশ্য, যেখানে জেমি ক্রোধান্বিত হতে থাকে। ছবি: ইন্টারনেট

ডিডেক্টিভ যে স্কুলে তদন্তের জন্য যান সেখানে তার ছেলেও পড়ে। সেও হেনস্তার শিকার যা সে বাবাকে বলেনি। একটি পর্যায়ে সে বাবাকে সাহায্য করতে চায়। কারণ সে বুঝতে পারে যে তার বাবা তার জেনারেশন ও ধ্যান ধারনা থেকে কেসটা দেখছে। একারণে সত্যিটা দেখতে পাচ্ছেনা। ওদিকে ডিডেক্টিভ হন্যে হয়ে হত্যার মোটিভ খুঁজছেন। কেন হত্যা করেছিল জেমি? থানায় সে অস্বীকার করছে হত্যার কথা। অথচ সিসিটিভিতে স্পষ্ট প্রমাণ আছে। তখন তার কিশোর পুত্র স্কুলের একটা ঘরে একাকী তার বাবাকে বোঝায় যে ইন্সটাগ্রামের পোস্টগুলো খুঁটিয়ে দেখতে।

এখানে ইমোজিগুলো দিয়ে বোঝা যায় যে আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও যেহেতু জেমির কোনো সঙ্গী নেই তানিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা ইংগিত করে কেটি ইন্সটাগ্রামে জেমিকে সবার সামনে কটাক্ষ করে মজা নিত। কেবল কতগুলো ইমোজি দিয়ে এতকিছু হতে পারে এটা ডিটেক্টিভ বুঝতেই পারছিলেননা। তার ছেলে জানায় যত রঙ এর হার্ট ইমোজি আছে প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা অর্থ আছে। ইমোজি এখন নতুন এক ভাষায় পরিণত হয়েছে যেখানে যৌনতার সাথে অপরাধ যুক্ত হয়ে এক বিকৃত রূপ নিয়েছে।   

চিল্ড্রেন্স কমিশনার ২০২৩ এর একটি সমীক্ষা বলছে, ১০% শিশু ৯ বছরে আসতে না আসতেই পর্নোগ্রাফির সম্মুখীন হয়েছে। বাবামায়েরা জানাচ্ছেন যে পর্নোগ্রাফি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় নারীবিদ্বেষি ইনফ্লুয়েন্সাররা শিশুদেরকে নারীবিদ্বেষি করে তুলছে। কেননা এলগরিদমের দুনিয়ায় একটি কন্টেন্টে সামান্য মনোযোগ দেওয়ার ফলে সেই ধরনের অজস্র কন্টেন্টের বলয়ে আটকা পড়ে যাচ্ছে শিশুর মন, ফলে সেটাই হচ্ছে তার বাস্তবতা। তাই স্ক্রিন টাইম সীমিত করে দিলেও লাভ নেই। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে। এলগরিদমে শিশুদের জন্য বিশেষ বিবেচনা তাদেরকে করতেই হবে।

মুক্তির প্রথম দুই সপ্তাহের মাঝে ৬৬.৩ মিলিয়ন দর্শক এই সিরিজটি দেখে ফেলেছে। বৃটিশ সিরিজগুলোর মধ্যে সেরা স্থান ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে ‘এডোলেসেন্স’। সিরিজটির একজন লেখক জ্যাক থ্রোন ব্রিস্টল বলেন শিশু কিশোরদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করা উচিৎ। তার এই মনোভাবের সাথে বেশিরভাগ বাবা-মা একমত হবেন। কিন্তু ডিভাইস সরিয়ে নিলে আপনার বাচ্চাকে কি দিবেন? আপনার কি অত সময় আছে? আপনি নিজে কতটা ডিভাইসে আসক্ত? ধরুন আপনি তার ডিভাইজ নিয়ে নিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে আপনার সন্তান কিছুই জানেনা কিন্তু স্কুলে সবাই জানে। এভাবে সে আর সবার থেকে আলাদা বলে আবার সহজ টার্গেট বনে যাবে। তাহলে কি করা যাবে? তার জন্য খেলার মাঠ আছে?

সিরিজটি অনেক সময়োপযোগী বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যেমন, ম্যানোস্ফিয়ার, আধুনিক পুরুষত্ব, অনলাইন ব্যুলিং। জেমি কোথায় ভুল করেছে? একটি প্রবাদ আছে, “একটি শিশুকে বড় করতে একটি গ্রামের প্রয়োজন হয়।” একটি শিশুকে ধ্বংস করতেও একটি গ্রামের প্রয়োজন। জেমিকে সিস্টেমেটিক্যালি ধ্বংস করা হয়েছে। তাকে ধ্বংস করেছে একটি স্কুল ব্যবস্থা যা তাকে সাহায্য করছে না। তাকে ধ্বংস করেছে তার বাবা-মা যারা যারা জানেননা কি চলছে জেমির মনে। তাকে ধ্বংস করেছে তার বন্ধুরা যারা তার সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরতে পারছেনা। তাকে ধ্বংস করেছে তার নিজের মস্তিষ্কের রসায়ন, এবং তাকে ধ্বংস করেছে সেই ধারণাগুলো যা সে গ্রহণ করেছে তার চারপাশ থেকে এবং অনলাইন দুনিয়া থেকে।   

ভ্যালিডেশন বা স্বীকৃতি পাওয়া এবং দৃশ্যমান হওয়ার এই সংস্কৃতি, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা আরো মোহনীয় করে তুলেছে সেটা বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষকে পূর্ণ করতে হবে। গায়ের রঙ কালো কেন, পোশাক এমন কেন, চুল ছোট কেন, ছেলে হয়ে কান্না কেন এইসব সামাজিক হ্যানস্থা করা থেকে বের হতে না পারলে আমরা নারীবিদ্বেষি ও শোষণের একটা বিকৃতিপূর্ণ সমাজের ভাগিদার হয়ে থাকব। অভিভাবকদের দলবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা এক্ষেত্রে অপরিহার্য। শিশুদের ডিজিটাল বয়স নির্ধারণের নীতিমালা, প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে নীতিমালা নিয়ে কাজ করা, কর্মশালার মাধ্যমে বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা, যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা এবং সৃষ্টিশীলতা বিকাশের জায়গা তৈরি করার প্রসঙ্গগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্ব রাখবে। 

a4 copy

জেমির ঘরে বসে তার বাবা ভাবছেন, কোথায় তিনি ভুল করলেন। ছবি: ইন্টারনেট

শিশুদের কথা শুনুন। তারা এখন খুবই ঝুঁকিতে আছে, এবং তাদের আপনাকে প্রয়োজন।  শিক্ষকরা, আপনারা ছাত্রদের কথা শুনুন। রাজনীতিবিদরা, তরুণদের কথা শুনুন। আমি মনে করি তারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অভিভাবকগণ, রোজ যে কিশোর কিশোরীদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন তাদের জীবনের ভাগিদার হন। আধুনিক মনোবিদদের মতে তাই বন্ধু নয়, বরং নির্ভরযোগ্য বাবা-মা হয়ে তাদের কথাগুলো শুনুন।



Source link

প্রসংঙ্গ :

Powered by WooCommerce

ছবি গপ্পো: বাবা-মায়ের জন্য যে বার্তা দিল জনপ্রিয় সিরিজ ‘এডোলেসেন্স’

আপডেটঃ ১১:৩৮:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫


২০২৫ এর ১৩ মার্চ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলো মিনি সিরিজ ‘এডোলেসেন্স’ (কৈশোর)। চার পর্বের এই সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে এক মর্মস্পর্শী আখ্যান, যেখানে ১৩ বছর বয়সী জেমি মিলারের নিষ্পাপ শৈশব কীভাবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে গড়িয়ে যায়। প্রতিটি পর্ব প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ, তবে এটি কোনো সাধারণ ক্রাইম থ্রিলার নয়। বরং সিরিজটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের নিয়ে যায় কিশোর মনের জটিল এক জগতে। জেমি কীভাবে তারই স্কুলের সহপাঠী কেটিকে হত্যা করল, তার পেছনের কারণ কী, সেই গল্প বলার ভঙ্গিটিই এই সিরিজের প্রধান শক্তি।

চারটি পর্বের প্রথমটিতে দেখা যায়, জেমিকে এরেস্ট করা থেকে শুরু করে থানায় কীভাবে আইনি উপায়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে দেখা যায়, জেমির স্কুলে ইনভেস্টিগেশনের নানা ধাপ। তৃতীয় পর্বে দেখা যায়, পুলিশি হেফাজতে থাকা জেমির সাথে একজন মনোবিজ্ঞানীর কথোপকথন। এবং শেষ পর্বে জেমির পরিবারের ভোগান্তি ও অপরাধবোধের কাব্য। এই গল্পগুলো শক্তভাবে ফুটে উঠেছে কেননা সিঙ্গেল-টেকে প্রতিটা পর্ব শ্যুট করা হয়েছে। এজন্য থানা, স্কুল, ইনভেস্টিগেশন রুম, জেমির পরিবারের চরিত্রগুলো  এতটাই নিরপেক্ষ এবং নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে যা বাস্তবতার কাছাকাছি।   

সাইবার ব্যুলিং ও কিশোর অপরাধ এখন এক আলোচনার বিষয় সেখানে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের জন্য ‘এডোলেসেন্স’ অনেক বড় একটা শিক্ষা। মূলত কৈশোর থেকেই একটা জেনারেশনের বিভাজন তৈরি হতে থাকে। দুঃখজনক হলেও কৈশোরের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং সামাজিক বিধিনিষেধ ও কামনাবোধ সেখানে লড়াইটা তাদের একা একা করতে হয়। এ কারণে দূরত্ব ও লুকোচুরি তৈরি হয় বাবা-মায়ের সাথে। প্রতিটি জেনারেশনই তার চেয়ে পরের জেনারেশনকে অনেক চালাক মনে করে। আসলে তারা নিজ নিজ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সিরিজে সেই কৈশোর দেখানো হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি ও নগর সংস্কৃতি আমাদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে ক্রমাগত খেলা করে চলেছে। এই খেলার ভয়ানক পরিণতি হিসেবে পরিচালক দেখিয়েছেন মানসিক ও সামাজিক বিকৃতি। এই ঘোর বিপদ কি আমরা টের পাচ্ছি? 

সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে যখন ডিটেক্টিভ জেমির স্কুলে যান তদন্তের জন্য তখন ডিস্তার্বড একদল কিশোর-কিশোরীদের দেখতে পান। স্কুলে জনপ্রিয় হওয়া, সুন্দর হওয়া, একজন সঙ্গী পাওয়া, পড়ালেখায় ভালো হওয়া, ধনী ঘর থেকে আসা, খেলাধুলা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডে ভালো হওয়া শিক্ষার্থীরা উঁচু শ্রেণিতে পড়ে। বাকিরা পড়ে নিচু শ্রেণিতে। সাধারণত সুবিধাজনক অবস্থানে যারা থাকে তারা বাকিদের হেনস্তা করে। আর সুবিধাবঞ্চিতদের মনে তীব্র বাসনা থাকে অপর দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। এই কারণে তাদের মাঝে তৈরি হয় প্রবল ঘৃণা ও কামনার এক জটিল প্রক্রিয়া। খেয়াল করলে দেখবেন এই বাস্তবতা আমাদের সমাজেও উপস্থিত। 

2 copy

নাবালক হওয়ায় বাবার সাথে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিচ্ছে জেমি। ছবি: ইন্টারনেট

জেমি মূলত ছিল সুবিধাবঞ্চিতের দলে, আর কেটি সুবিধাবানদের দলে। জেমির ইন্সটাগ্রাম একাউন্টে কেটি তাকে হেনস্তা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। ইমোজির ভাষায় অহরহ ঘটতে থাকা এই প্রসঙ্গগুলো বাবা-মা বুঝতে পারবেননা। এনিয়ে জেমির ক্ষোভ থাকলেও সে মনে মনে কেটিকে কামনা করত। কেটির ব্যক্তিগত ছবি স্কুলে ভাইরাল হয়ে যায়। তখন কেটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জেমি ভাবে এই দুর্বলতার মুহূর্তে প্রেম নিবেদন করলে হয়তো কেটি তার কথা শুনবে। কিন্তু তা হয় না, বরং কেটি বেশ ক্ষিপ্ত হয়। জেমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। প্রত্যাখ্যাত হলে কেটি আবারো সামাজিক মাধ্যমে তাকে হেনস্তা করতে পারে এটা তার জানা।

তাই সে তার বন্ধুর বাড়ির রান্নাঘর থেকে আনা চাকু দিয়ে সাতবার কেটিকে আঘাত করে মেরে ফেলে। পরবর্তীতে যখন মনোবিজ্ঞানীর সাথে জেমি কথা বলে তখন এই ঘটনায় হত্যার প্রসঙ্গটি স্বীকার না করলেও কেটির দেহের কোনো অংশ যে সে স্পর্শ করেনি এটা বারবার বলছিল। যেন এইজন্য সে বাহবা পাওয়ার যোগ্য। সে ধর্ষন করেনি, নিপীড়ন করেনি যা সে করতে পারতো। এই দাবীর মধ্য দিয়ে নারীবিদ্বেষের এমন সূক্ষ্মভাব টের পাওয়া যায় যা দর্শকরাও হয়তো বুঝতে পারতেননা যদিনা দৃশ্যে থাকা মনোবিজ্ঞানী একজন নারী না হতেন। প্রাপ্তবয়স্ক পেশাদার একজন মনোবিজ্ঞানীও যেন নিজেকে খুব কষ্ট করে ধরে রেখেছেন কেননা জেমি রাগে ফেটে পড়ছিল। কোথা থেকে আসে এত রাগ? 

ঘটনা অতি সামান্য। কাউকে হত্যা করার মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু কৈশোরে ঐটাই তাদের দুনিয়া। ডিভাইসে আসক্ত শিশুদের দুনিয়া ভয়ানক সীমিত। জেমির বাবা-মা বার বার নিজেদের ভুল খোঁজার চেষ্টা করেন। ছেলেকে কোথায় ভুল শিক্ষা দিলেন যে আজ এইদিন তাদের দেখতে হচ্ছে। ছেলের প্রতি তাদের কোনো ঘৃণা নেই। অতটুকু ছোটমুখ দেখলে কারোরই ঘৃণা আসবে না। কিন্তু বাড়িতে এমন কোনো পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাকে বড় করা হয়নি যে সে একজন খুনি হয়ে উঠবে।

বাড়িতে তার কোনো চাওয়া পাওয়াও পিতামাতা অপূর্ণ রাখেনি যে সে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে করবে। ভালোমানের কম্পিউটার ও গেমিং এর সরঞ্জাম তার আছে। জেমির বড় বোন খুব স্বাভাবিক আর পাঁচটা কিশোরীর মতই আচরণ করে। তার আচরণে কেউ বুঝতেও পারবেনা যে তার ভাই খুনি হতে পারে। অর্থাৎ জেমির খুনি হয়ে ওঠার পিছনে তার পারিবারিক আবহকে এককভাবে দায়ী করা যাচ্ছে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে ছেলের জীবনে কি চলছে, সে কি নিয়ে মনে মনে চাপবোধ করছে এগুলো সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেননা। 

a2

পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন জেমির সাথে মনোবিজ্ঞানীর আলাপচারিতার একটি দৃশ্য, যেখানে জেমি ক্রোধান্বিত হতে থাকে। ছবি: ইন্টারনেট

ডিডেক্টিভ যে স্কুলে তদন্তের জন্য যান সেখানে তার ছেলেও পড়ে। সেও হেনস্তার শিকার যা সে বাবাকে বলেনি। একটি পর্যায়ে সে বাবাকে সাহায্য করতে চায়। কারণ সে বুঝতে পারে যে তার বাবা তার জেনারেশন ও ধ্যান ধারনা থেকে কেসটা দেখছে। একারণে সত্যিটা দেখতে পাচ্ছেনা। ওদিকে ডিডেক্টিভ হন্যে হয়ে হত্যার মোটিভ খুঁজছেন। কেন হত্যা করেছিল জেমি? থানায় সে অস্বীকার করছে হত্যার কথা। অথচ সিসিটিভিতে স্পষ্ট প্রমাণ আছে। তখন তার কিশোর পুত্র স্কুলের একটা ঘরে একাকী তার বাবাকে বোঝায় যে ইন্সটাগ্রামের পোস্টগুলো খুঁটিয়ে দেখতে।

এখানে ইমোজিগুলো দিয়ে বোঝা যায় যে আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও যেহেতু জেমির কোনো সঙ্গী নেই তানিয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা ইংগিত করে কেটি ইন্সটাগ্রামে জেমিকে সবার সামনে কটাক্ষ করে মজা নিত। কেবল কতগুলো ইমোজি দিয়ে এতকিছু হতে পারে এটা ডিটেক্টিভ বুঝতেই পারছিলেননা। তার ছেলে জানায় যত রঙ এর হার্ট ইমোজি আছে প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা অর্থ আছে। ইমোজি এখন নতুন এক ভাষায় পরিণত হয়েছে যেখানে যৌনতার সাথে অপরাধ যুক্ত হয়ে এক বিকৃত রূপ নিয়েছে।   

চিল্ড্রেন্স কমিশনার ২০২৩ এর একটি সমীক্ষা বলছে, ১০% শিশু ৯ বছরে আসতে না আসতেই পর্নোগ্রাফির সম্মুখীন হয়েছে। বাবামায়েরা জানাচ্ছেন যে পর্নোগ্রাফি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় নারীবিদ্বেষি ইনফ্লুয়েন্সাররা শিশুদেরকে নারীবিদ্বেষি করে তুলছে। কেননা এলগরিদমের দুনিয়ায় একটি কন্টেন্টে সামান্য মনোযোগ দেওয়ার ফলে সেই ধরনের অজস্র কন্টেন্টের বলয়ে আটকা পড়ে যাচ্ছে শিশুর মন, ফলে সেটাই হচ্ছে তার বাস্তবতা। তাই স্ক্রিন টাইম সীমিত করে দিলেও লাভ নেই। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে। এলগরিদমে শিশুদের জন্য বিশেষ বিবেচনা তাদেরকে করতেই হবে।

মুক্তির প্রথম দুই সপ্তাহের মাঝে ৬৬.৩ মিলিয়ন দর্শক এই সিরিজটি দেখে ফেলেছে। বৃটিশ সিরিজগুলোর মধ্যে সেরা স্থান ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে ‘এডোলেসেন্স’। সিরিজটির একজন লেখক জ্যাক থ্রোন ব্রিস্টল বলেন শিশু কিশোরদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করা উচিৎ। তার এই মনোভাবের সাথে বেশিরভাগ বাবা-মা একমত হবেন। কিন্তু ডিভাইস সরিয়ে নিলে আপনার বাচ্চাকে কি দিবেন? আপনার কি অত সময় আছে? আপনি নিজে কতটা ডিভাইসে আসক্ত? ধরুন আপনি তার ডিভাইজ নিয়ে নিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে আপনার সন্তান কিছুই জানেনা কিন্তু স্কুলে সবাই জানে। এভাবে সে আর সবার থেকে আলাদা বলে আবার সহজ টার্গেট বনে যাবে। তাহলে কি করা যাবে? তার জন্য খেলার মাঠ আছে?

সিরিজটি অনেক সময়োপযোগী বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যেমন, ম্যানোস্ফিয়ার, আধুনিক পুরুষত্ব, অনলাইন ব্যুলিং। জেমি কোথায় ভুল করেছে? একটি প্রবাদ আছে, “একটি শিশুকে বড় করতে একটি গ্রামের প্রয়োজন হয়।” একটি শিশুকে ধ্বংস করতেও একটি গ্রামের প্রয়োজন। জেমিকে সিস্টেমেটিক্যালি ধ্বংস করা হয়েছে। তাকে ধ্বংস করেছে একটি স্কুল ব্যবস্থা যা তাকে সাহায্য করছে না। তাকে ধ্বংস করেছে তার বাবা-মা যারা যারা জানেননা কি চলছে জেমির মনে। তাকে ধ্বংস করেছে তার বন্ধুরা যারা তার সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরতে পারছেনা। তাকে ধ্বংস করেছে তার নিজের মস্তিষ্কের রসায়ন, এবং তাকে ধ্বংস করেছে সেই ধারণাগুলো যা সে গ্রহণ করেছে তার চারপাশ থেকে এবং অনলাইন দুনিয়া থেকে।   

ভ্যালিডেশন বা স্বীকৃতি পাওয়া এবং দৃশ্যমান হওয়ার এই সংস্কৃতি, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা আরো মোহনীয় করে তুলেছে সেটা বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষকে পূর্ণ করতে হবে। গায়ের রঙ কালো কেন, পোশাক এমন কেন, চুল ছোট কেন, ছেলে হয়ে কান্না কেন এইসব সামাজিক হ্যানস্থা করা থেকে বের হতে না পারলে আমরা নারীবিদ্বেষি ও শোষণের একটা বিকৃতিপূর্ণ সমাজের ভাগিদার হয়ে থাকব। অভিভাবকদের দলবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা এক্ষেত্রে অপরিহার্য। শিশুদের ডিজিটাল বয়স নির্ধারণের নীতিমালা, প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে নীতিমালা নিয়ে কাজ করা, কর্মশালার মাধ্যমে বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা, যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা এবং সৃষ্টিশীলতা বিকাশের জায়গা তৈরি করার প্রসঙ্গগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্ব রাখবে। 

a4 copy

জেমির ঘরে বসে তার বাবা ভাবছেন, কোথায় তিনি ভুল করলেন। ছবি: ইন্টারনেট

শিশুদের কথা শুনুন। তারা এখন খুবই ঝুঁকিতে আছে, এবং তাদের আপনাকে প্রয়োজন।  শিক্ষকরা, আপনারা ছাত্রদের কথা শুনুন। রাজনীতিবিদরা, তরুণদের কথা শুনুন। আমি মনে করি তারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অভিভাবকগণ, রোজ যে কিশোর কিশোরীদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন তাদের জীবনের ভাগিদার হন। আধুনিক মনোবিদদের মতে তাই বন্ধু নয়, বরং নির্ভরযোগ্য বাবা-মা হয়ে তাদের কথাগুলো শুনুন।



Source link