ইউক্রেনে ২০২২ সালে হামলা চালানোর পর রাশিয়াকে শাস্তি দিতে একাট্টা হয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। তারা চেয়েছিল, রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দিতে। এ লক্ষ্যে মস্কোর আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস জ্বালানির ওপর অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা।
কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়াকে প্রায় জর্জরিত করে ফেললেও গত এক বছরে দেশটির তেমন অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়নি। তিন দিন আগে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও জানান, পশ্চিমারা ভেবেছিল রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি।
কেন হয়নি? অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও কেন দুর্বল হয়নি রুশ অর্থনীতি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এর অন্যতম বড় কারণ চীন ও ভারত। এ দুই দেশের ‘জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ক্ষুধাই’ রাশিয়াকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
পশ্চিমারা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর রাশিয়ার কাছ থেকে সাধারণের চেয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেল কেনা শুরু করে এশিয়ার দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত ও চীন। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে এ দুই দেশকেও চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেগুলোতে তারা কর্ণপাত করেনি।
আল জাজিরা জানিয়েছে, ২০২২ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে চীনের অপরিশোধিত তেল কেনার পরিমাণ ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মানে অন্য সময়ের তুলনায় প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ব্যারল বেশি তেল কিনেছে বেইজিং। চীনের কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তাদের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ তেল সরবরাহকারী দেশ হলো রাশিয়া।
বাজার বিশ্লেষক সংস্থা কেপলার জানিয়েছে, শুধুমাত্র এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিদিন ৫ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ব্যারল তেল কিনেছে চীন। যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
অপরদিকে রাশিয়ার কাছ থেকে চীনের পাইপলাইন গ্যাস ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার পরিমাণ দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুধু তাই নয় গত বছর রাশিয়ার কাছ থেকে যে পরিমাণ কয়লা বেইজিং কিনেছে, সেটি আগের বছর থেকে ২০ শতাংশ বেশি।
অপরদিকে যুদ্ধ বাধার পর রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশে হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ভারত। এ বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিদিন ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ব্যারল তেন কিনেছে দিল্লি। যা গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ৯ শতাংশ বেশি।
এছাড়া ২০২২ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত ১৬১ দশমিক ১৮ মিলিয়ন টন তাপ কয়লা কিনেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে তেল কেনার সুযোগ পেয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতে মুদ্রাস্ফীতি এবং সামনে নির্বাচন থাকায় এ প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। মোদি পশ্চিমাদের সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছেন আবার একই সময় মস্কোর সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজা রেখেছেন।
ভারত ও চীন ছাড়াও তুরস্কও রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং কয়লার অন্যতম বড় ক্রেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এছাড়া বিশ্লেষকরা বলছেন, কম দামে জ্বালানি পেতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও এসব দেশের পথে হাঁটতে পারে।
নতুন ক্রেতা খোঁজার পাশাপাশি পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যেতে অন্যান্য উপায়ও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে রাশিয়া। ইকোনোমিস্ট ইনটিলিজেন্স ইউনিট জানিয়েছে, ইরানের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মস্কো ৬০০টির বেশি ‘শেডো ফ্লিট’ তৈরি করেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের তেলের ট্যাংকারগুলোর চাহিদা বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিঙ্গাপুরে অন্যান্য দেশের জ্বালানি তেলের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানি মিলিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। যার কারণে কোনটি রাশিয়ার তেল সেটি খুঁজে বের করার বিষয়টি কঠিন হয়ে গেছে।
তবে চীন এবং ভারত বিপুল জ্বালানি আমদানি করলেও ২০২২ সালে রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রির লাভ প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কারণ তাদের কম দামে জ্বালানি বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন বিকল্পও ভাবছে মস্কো।
আরেকটি বিষয় এখন যেটি ধারণা করা হচ্ছে সেটি হলো, এ বছর ভারতকে ছাড়িয়ে রাশিয়ার জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারকের জায়গা নেবে চীন।
সূত্র: আল জাজিরা