অবিরাম শোনানো হলো ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই’ ধরনের মিষ্টি কথা। ‘ক্ষমতা চাই না, চাই কেবল বাংলার মানুষের মুখ হাসি ফোটাতে’ -এ কথাও আওড়ানো হয়েছে শতবার-হাজারবার। ভেতরের যে এতো গলদ! যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলয়ে থাকা সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তির সন্ধান তার ঘনিষ্টদেরও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে তাদের বিনিয়োগ করা সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের (৬ হাজার কোটি টাকা) বেশি। শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠদের প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির মধ্যে ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল ম্যানশন পর্যন্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও দেশটির বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এই সম্পত্তির অনেকগুলো কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে কেনা হয়েছে এসব সম্পত্তি । ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম অবজারভার ও বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এই অনুসন্ধান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মানুষকে শোনালেন কী? আর ভেতরে ভেতরে কারবারটা করলেন কী? জবাবহীন প্রশ্ন। আওয়ামী ক্ষমতায় থাকতেও এ নিয়ে কথাবার্তা ছিল। তবে, এগুলোকে গুজব, আকথা, উড়াকথা ইত্যাদি নাম দিয়ে বলা হতো বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র।
এরমধ্যে মাস তিনেক সময়ে যদ্দুর সম্ভব তথ্য-সাবুদ জোগাড় করে অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটিও বোমা ফাটিয়ে বসেছে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থই তছরুপ হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ১০ শতাংশ মানুষের কাছেই ৮৫ শতাংশ সম্পদ চলে গেছে গত ১৫ বছরে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম করা যাবে না মর্মে উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ভাবা যায় কোন পর্যায়ে গেছে দুর্বৃত্তায়ন? অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে। এতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে।
লুটপাটের সেই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না-তা অভ্যুত্থানের বিপ্লবীদের জন্য সহ্য করা কঠিন। ভরসার জায়গা হচ্ছে, অর্থ আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এসব অর্থ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ কেলেঙ্কারি এবং অনিয়মিত ঋণের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। যা দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র পাঠ্যপুস্তকে জায়গা দেয়ার মতো বিষয়। ড. দেবপ্রিয়র ভাষায়- চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপিএবং মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব টাকা লোপাট করা হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে সেই বোঝা থেকে গেলো।
সেই বিবেচনায় প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য একটা ঐতিহাসিক দলিল। জাতি এই নথি থেকে উপকৃত হবে। আর্থিক খাতে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা ছিল একটা আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়। সবার সামনে এসব লুটতরাজ ঘটলেও কেউ এটা নিয়ে কথা বলেনি। কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, তারা যতটা ভেবেছিলেন সমস্যাটি তার চেয়ে গভীর। ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে কীভাবে এবং কোথায় অর্থপাচার হয়েছে সেই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে-বাংলাদেশ থেকে প্রধানত সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস, বাহামাস এবং অন্যান্য ট্যাক্স হ্যাভেন দেশগুলোতে অর্থ পাচার করা হয়েছে। তা হয়েছে তিনভাবে।
প্রথম ধাপে প্লেসমেন্ট বা পাচারকৃত অর্থ স্থানান্তর করা হয়। তারপর অর্থকে বিভিন্ন চ্যানেলে সরানো হয়, যাতে এর উৎস গোপন করা যায়। তৃতীয় ধাপে অর্থকে বৈধভাবে পুনঃস্থাপন করা হয়, যাতে এটি বৈধ উপায়ে দেশে ফিরতে না পারে। এ কুকর্মে তারা এখন পর্যন্ত সফল। বলা হয়ে থাকে বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন। ৫ আগস্টও কঠিন ছিল। কেবল কঠিন নয়, ধারণারও বাইরে ছিল। সেই কঠিনকে জয় করে গণঅভ্যুত্থানে জগদ্দল পাথর সরানো হয়েছে। আয়রন লেডি খ্যাত শেখ হাসিনাকে এক কাপড়ে পালাতে হয়েছে। তার ঘনিষ্টদের অনেকে পালিয়েছেন। আটকা পড়েছেন কয়েকজন। অসম্ভবকে সম্ভব করে এতো কঠিন জয়ের পর এখন পাচারকৃত টাকা ফেরানো যাবে না, ধরনের কথা শুনতে চায় না মানুষ।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই হাসিনা দেশটাকে তাঁর সাম্রাজ্য হিসেবে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করার মিশনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরা। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায় হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প দাবি করেছে যে শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে জয় এবং শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন। দেশে এখনো চলমান বশে কিছু প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত।
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা পতনের পর এই তিন-সাড়ে তিন মাসেও তার স্বজন বিশেষ করে লুটপাটে জড়িত একজনও ধরা পড়েনি। যথাসময়ে তাদের আগেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের সবারই বিদেশে বাড়িঘর রয়েছে। কারো কারো নাগরিকত্বও রয়েছে। পাচারকৃত অর্থে বাকি জীবন বিদেশে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবেন তারা? লুটপাটের সেই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না-তা অভ্যুত্থানের বিপ্লবীদের জন্য সহ্য করা কঠিন। ভরসার জায়গা হচ্ছে, অর্থ আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
লেখক: সাংবাদিক -কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/জিকেএস