বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময় থেকেই গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে উত্তরের মৃদু বাতাসে সোনালী ধান দুলছে। উত্তরের বাতাসে পাঁকা ধানের সুমিষ্ট ঘ্রাণে মুখরিত হওয়ায় মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায় কৃষকের।
কিশোরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় পুরোদমে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকার কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটতে আমন ক্ষেতে কাজ করছেন। পাশাপাশি শ্রমিক কৃষাণীরা ধান মাড়াইয়ের কাজ করছে। এ মৌসুমে রোপা আমন ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। ফলে উৎসব মুখর পরিবেশে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। এছাড়া গরুর খাদ্য হিসেবে খড়ের চাহিদা বৃদ্ধি ও ধানের দাম ভালো থাকায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি আর বাড়তি জ্বালানির দামে বিপাকে পড়েন কৃষকেরা। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার কিশোরগঞ্জে আমনের ফলন ভালো হয়েছে। মাঠে মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ধান কাটছেন কৃষক। একই সঙ্গে চলছে ধান মাড়াই-ঝাড়াই ও শুকানোর কাজ। জমির পাশেই ধান সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে বাড়িতে নিতে ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণীরা। শুধু বাম্পার ফলনই নয়, বাজারে ধানের দামও ভালো থাকায় খুশি ঝরছে প্রতিটি কৃষকের মুখে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার রোপা আমনের ফলন ভালো হয়েছে। অগ্রাহণের শুরুর দিক থেকেই রোপা আমনের ক্ষেতে সোনালী নবান্নের বার্তা বইছে। কৃষকরা তাদের জমি থেকে সোনালী রোপা আমন কাটতে শুরু করেছেন এবং কাটার পর তা মারাই করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। ধান মারাইয়ের পর তা থেকে আগাছা পরিষ্কার করার জন্য নারীরা কুলা দিয়ে তা উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন। অনেক কৃষক ধান কেটে জমিতেই মাড়াই ও বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা এসে ক্ষেত থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ধান কাটার পর ওই জমিতে আগাম আলুসহ শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যে চলছে ব্যাপক প্রস্ততি। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নের ফসল আগাম আলু রোপণে জোরেসোরে মাঠে কাজ করছেন আলুচাষিরা।
কৃষকরা বলছেন, এবার রোপা আমন চাষে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তবে অল্প কিছু এলাকায় ব্রি ১০৩ ধানের বীজ রোপণের পর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধানের শীষ গজানোর ফলে ধানে চিটা ধরাসহ ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এর পরিমাণ খুবই কম। বেশির ভাগ এলাকায় প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া পোকা-মাকড়ের আক্রমণও ছিল কম। ফসল নষ্টকারী ইঁদুরের আক্রমণ ছিল শঙ্কার চেয়ে কম। সব মিলিয়ে ধান চাষে আবহাওয়া ছিল অনুকূল। তারা আরও বলছেন, ফলন বেশি হলে দাম কমে যায়। এটা কৃষকদের জন্য কষ্টকর। তবে এবার প্রথম থেকেই ধানের দাম ভালো রয়েছে। ধানের বাজার খুব একটা কমার সম্ভাবনা নেই।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দিগন্তজোড়া মাঠে সবুজের মাঝে সোনালী ধানের ঝিলিক। কোথাও পাকা ধান আবার কোথাও আধাপাকা ধান। কৃষকেরা ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেইসঙ্গে কৃষাণীরাও মনের আনন্দে ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার কাজে সাহায্য করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবার কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলায় ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন চাল। এ মৌসুমে উপজেলায় ব্রি ধান-১০৩, বি-আর ২৮, বি-আর ২৯সহ বিভিন্ন প্রজাতির ধান চাষ করেছে কৃষকরা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রোপা আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। ফসলের দাম ভালো থাকায় এই বছর ধান কাটা শ্রমিকের সংকট লক্ষ্য করা যায়নি। এ বছর ধানের দামও বেশ ভাল। প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া জানান, পাঁচ একর জমিতে তাদের প্রায় ৩৫০ মণ ধান হয়েছে। বাম্পার ফলন পেয়ে পরিবারের সবাই খুশি। এবার ধারের টাকায় চাষাবাদ করেছেন। তারপরও বাজারে দরও বেশ ভালো। উৎপাদন ব্যয় বেশী হলেও এবার পুষিয়ে নিয়েছেন।
পাকুন্দিয়া উপজেলার চরটেকি গ্রামের কৃষক মেরাছ মিয়া জানান, আমি দেড় একর জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করেছি। রোপা আমন ধান কাটা শুরু করেছি। এসব জমির ধান কয়েক দিনের মধ্যে ঘরে তুলতে পারব। তবে জমির ধান কেটে আবার আলুসহ শীতকালীন সবজি চাষ করব। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ধানের থেকে গো-খাদ্য খড়ের চাহিদা ও মূল্য বেশি থাকায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এ ধান বিক্রি করে চাষিরা পরবর্তী কৃষিপণ্য সরিষা, মশুরী, কলাই ও গম চাষের অর্থ জোগান দিচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় প্রথমদিকে বৃষ্টিপাতের কিছুটা সমস্যা থাকলেও পরে আশানুরূপ বৃষ্টিপাতের ফলে রোপা আমনের চারা রোপণে সমস্যা হয়নি। এ মৌসুমে ধান চাষে তেমন বাড়তি খরচ করতে হয়নি কৃষকদের। ফলনও ভালো হয়েছে। অন্যদিকে দামও বেশ ভালো রয়েছে। কৃষকরা লাভবান হবেন।