শীতের সময় তীব্র শীত। আবার গরমের সময় প্রচণ্ড গরম। এ হলো চুয়াডাঙ্গার আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য। গত শীত মৌসুমে চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রিতে নেমেছিল। তখন এটা ছিল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। দেশে প্রচণ্ড শীত পড়ে—এমন তিনটি স্থানের একটি চুয়াডাঙ্গা। এখন আবার গরমে রেকর্ড করতে চলেছে এ জেলা। গতকাল সোমবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকছে। গরমে হাঁসফাঁস আর শীতে কেন কাঁপা কাঁপি—এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ও ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ভূপ্রাকৃতিক কিছু কারণেই এ ঘটনা ঘটে। সঙ্গে আছে চুয়াডাঙ্গার ভৌগোলিক অবস্থান।
এবার আসা যাক শীতের প্রসঙ্গে। আবহাওয়াবিদেরা বলেন, বাংলাদেশে শীত ও গ্রীষ্ম উভয়েই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে, অর্থাৎ ভারতের কাশ্মীর, দিল্লি—এসব এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসে।
কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডার মধ্যে হরেক রকম পণ্য নিয়ে সাইকেলে রওনা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ এক বিক্রেতা। গ্রামে গ্রামে হেঁটে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করেন তিনি। শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট সড়কে গতকাল সকাল পৌনে আটটায়
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, উত্তর গোলার্ধ থেকে আসা শীতল বায়ু বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলে সোজা হয়ে ঢুকতে পারে না। এ বায়ুর একটি অংশ কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের একাংশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গরমের দিনে দিল্লির তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসতে থাকে। আবার শীতকালে দিল্লির অতি শীত ধীরে ধীরে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসে। শীতের সময় এই উত্তরের হাওয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ঢোকে।
বজলুর রশীদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, শীত ও গ্রীষ্মে ভূমিকা রাখা মহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের প্রবেশদ্বার চুয়াডাঙ্গা এবং এর কাছাকাছি এলাকাগুলো। গরমের সময় ভারতের গুজরাট বা এসব এলাকায় সৃষ্টি হওয়া তপ্ত হাওয়া নানা পথ পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। আর তা আসে চুয়াডাঙ্গার প্রান্ত দিয়ে।
চুয়াডাঙ্গায় মাঝারি দাবদাহ বয়ে চলেছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। ফেরি করে ক্লান্ত বাদাম বিক্রেতা লিটন আলী মুখে পানি দিয়ে স্বস্তি আনার চেষ্টা করছেন। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় শহরের সাহিত্য পরিষদের সামনে
স্থানীয় ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চুয়াডাঙ্গায় গরম ও শীত তীব্র—এমনটা ধারণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চুয়াডাঙ্গায় জলাভূমি অপেক্ষাকৃত কম। জলাভূমি বেশি থাকলে শীতকালে তা শীত ধারণ করে ঠান্ডা কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এ জনপদে তা হয় না। এ কারণে শীত দীর্ঘায়িত হয়। আবার গরমের সময় জলাভূমির স্বল্পতার জন্য আর্দ্রতা ধরে রাখা যায় না। ফলে গরম বাড়ে।
চার মাস আগেই শীত মৌসুমে চুয়াডাঙ্গায় একাধিকবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। গত ১২ জানুয়ারি জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল ওই দিন সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। ৬ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত সাত দিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়। মাঝারি থেকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহের প্রকোপে জনজীবন তখন স্থবির হয়ে পড়েছিল।
১০ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড
২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গা জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০২ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠার পর যা ছিল জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর পরের কয়েক বছরে একাধিকবার তাপমাত্রা ৪০-এর ঘর ছুঁয়েছে। ২০১৫ সালের ২২ মে তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি, ২০১৬ সালে ১১ ও ২২ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি, ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ২০১৮ সালের ১৮ জুন ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি, ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি, ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি, ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি এবং গত বছরের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল ওই বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসানের দাবি, কর্কটক্রান্তি রেখার খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে চুয়াডাঙ্গা। মূলত, ভৌগোলিক কারণেই এ জেলায় শীত মৌসুমে তীব্র শীত ও গরমকালে তীব্র গরম হয়।