ইসলামি শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া ইসলামে জন্ম নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। বিশেষ করে দারিদ্র্যের ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ রিজিকের একমাত্র মালিক আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের অভাবের ভয়ে হত্যা করো না। তাদের রিজিক আমিই দিয়ে থাকি এবং তোমাদেরও। তাদের হত্যা করা মহাপাপ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩১)
ভ্যাসেকটমি ও লাইগেশনের মাধ্যমে পুরুষ বা নারীর সন্তান নেওয়ার ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হারাম। কারণ এতে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা রাসুল (স.)-এর সঙ্গে জিহাদে অংশ নিতাম। কিন্তু আমাদের কোনো কিছু ছিল না। সুতরাং আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে বললাম, আমরা কি খাসি হয়ে যাব? তিনি আমাদের খাসি হতে নিষেধ করলেন এবং কোনো মহিলার সঙ্গে একখানা কাপড়ের বিনিময়ে হলেও শাদী করার অনুমতি দিলেন এবং আমাদের এই আয়াত পাঠ করে শোনালেন, হে মুমিনরা! আল্লাহ যে পবিত্র জিনিসগুলো তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তোমরা তা হারাম কোরো না এবং সীমা লঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (বুখারি: ৪৭০৯)
নির্ধারিত মেয়াদের জন্য ইনজেকশন, নিরাপদকাল মেনে চলা, আইইউডি ব্যবহার করা ইত্যাদি পদ্ধতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করাও মাকরুহ তাহরিমি। যা হারামের কাছাকাছি। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী বা সন্তানের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনে অভিজ্ঞ দ্বীনদার ডাক্তারের পরামর্শক্রমে কনডম বা জন্ম নিরোধক পিল ব্যবহার ইত্যাদি পদ্ধতিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে তা জায়েজ। (আহকামে জিন্দেগি: ৫৫৮)
অনেকে দারিদ্র্যের আশংকায় জায়েজ ভেবে ভ্রূণ হত্যার মতো গর্হিত অপরাধ করে বসে। অথচ এর কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে মানুষ সন্তান হত্যা করত। আধুনিক যুগে জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভ্রূণ হত্যা ওই যুগে সন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার নামান্তর। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বলেন, আল্লাহর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী স্থির করা; অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, এটা তো বড় গুনাহ বটে। এরপর কোনটি? তিনি বলেন, আপন সন্তানকে এ আশঙ্কায় হত্যা করা যে সে তোমার আহারের সঙ্গী হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেন, তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। (তিরমিজি: ৩১৮২; আবু দাউদ: ২০০০)
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে কেউ কেউ জন্ম নিয়ন্ত্রণে আজল পদ্ধতি গ্রহণ করত। (সংগমকালে বীর্য স্ত্রী যোনির বাইরে স্খলন করা) এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে তিনি নির্দেশ দেননি। সরাসরি নিষেধও করেননি। তবে একটি হাদিসে এটাকে গুপ্ত হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। জুদামা বিনতে ওয়াহব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন কিছুসংখ্যক লোকের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হাজির হলাম। তিনি তখন বলেছিলেন, আমি স্তন্যদায়িনী নারীর সঙ্গে সংগম করতে নিষেধ করার ইচ্ছা করলাম, এ অবস্থায় আমি রোম ও পারস্যবাসী লোকদের অবস্থার কথা বিবেচনা করে অবগত হলাম যে তারা স্তন্যদায়িনীর সঙ্গে সংগম করে থাকে, কিন্তু তা তাদের সন্তান-সন্ততির কোনো ক্ষতি করে না। তারপর লোকেরা তাঁকে আজল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তাহলো গোপন হত্যা। (মুসলিম: ৩৪৩৪)
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইচ্ছা ছিল উম্মাহর সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এর তাগিদ তিনি দিয়েছেন। মাকাল ইবনে ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারিম (স.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বলে, আমি এক সুন্দরী ও মর্যাদাসম্পন্ন রমণীর সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু সে কোনো সন্তান প্রসব করে না (বন্ধ্যা)। আমি কি তাকে বিবাহ করব? তিনি বলেন, না। অতঃপর সে ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এসে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে নিষেধ করেন। পরে তৃতীয়বার সে ব্যক্তি এলে তিনি বলেন, তোমরা এমন স্ত্রীলোকদের বিবাহ করবে, যারা স্বামীদের অধিক মহব্বত করে এবং অধিক সন্তান প্রসব করে। কেননা আমি (কিয়ামতের দিন) তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে (পূর্ববর্তী উম্মতের ওপর) গর্ব প্রকাশ করব। (আবু দাউদ: ২০৪৬)
সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় গর্ভনিরোধ, গর্ভপাত ও ভ্রূণ হত্যা নিষিদ্ধ। নির্ধারিত সময় পার হলে ভ্রূণ হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। ফিকহ শাস্ত্রের সব ইমাম এক মত যে মানব ভ্রূণে ‘রুহ’ ফুঁকে দেওয়ার পর তথা গর্ভধারণের ১২০ দিন পর তা গর্ভপাত করানো একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হত্যার সমান অপরাধ। কেননা রুহ তথা জীবন লাভ করায় সে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যথার্থ কারণ ছাড়া আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ (সুরা আনআম: ১৫১; আল-কাওয়ানিন আল-ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠা-১৪১)
গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যে ‘রুহ’ সৃষ্টির আগেও ভ্রূণ হত্যা করা নিষিদ্ধ। তবে শরিয়ত অনুমোদিত কারণে গর্ভপাত করা জায়েজ আছে। যেমন মায়ের জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়া। তবে এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামত গ্রহণ করা শর্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু যে অনন্যোপায় অথচ অবাধ্য নয় কিংবা সীমালঙ্ঘনকারী নয়, তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা: ১৭৩; আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, পৃষ্ঠা-৫০২০)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে অকারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ভ্রূণ হত্যার মতো গর্হিত অপরাধ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
সূএ:ঢাকা মেইল ডটকম