গত ২৫শে জানুয়ারি’২৫ তারিখে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন-এর চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর কাছে পেশাজীবী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ-এর পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার সংক্রান্ত ৮ দফা প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ-
১। দক্ষ ও জনকল্যাণমুখী আমলাতন্ত্র গঠনের লক্ষ্যে পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন করা। অর্থাৎ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের খাত সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত কর্মকর্তারা উক্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বা তদুর্দ্ধ পদে অংশ নিতে পারবেন- এমন নীতিমালা প্রণয়ন করা।
২। উপসচিব পরীক্ষায় কোটা ব্যবস্থা বাতিলকরণ এবং উন্মুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক ও মন্ত্রণালয়ের খাত ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগ প্রদান করা।
৩। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকুরীজীবীদের মধ্যে সমতা বিধান নিশ্চিত করা। অর্থাৎ চাকুরীজীবীদের মধ্যে বৈষম্যমূলক ক্যাডার ও নন-ক্যাডার/ ক্যাডার বহির্ভূত- এই শ্রেণী বিভাজন নিরসন করে সরকারি সব ‘ফাংশনারিজ’-কে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করা।
৪। উপসচিব পদের পরীক্ষায় একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে দক্ষ, সুশিক্ষিত, ও খাত সংশ্লিষ্ট কাজে নির্দিষ্ট সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত/ প্রবাসী ব্যক্তিবর্গকেও সুযোগ দেয়া; এতে করে সরকারি সেবার মান উন্নয়ন এবং আমলাতন্ত্রিক কার্যক্রমে আরও গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
৫। প্রকৌশলীদের সকল সেক্টরের জন্য একটি অভিন্ন ‘সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস’ চালু করা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সকল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে প্রকৌশলীদের নিয়োগ করা হবে। এই সার্ভিস থেকে প্রকৌশলরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উপসচিব পদে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৬। জনকল্যাণমুখী ও জবাবদিহিমূলক সিভিল সার্ভিস প্রণয়ন করা। দুর্নীতি ও মানবতা বিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করার বিধান সার্ভিস রুলে অন্তর্ভুক্ত করা। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি ইত্যাদি অভিযোগ দাখিল করার জন্য সহজে এক্সেসিবল কার্যকর ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
৭। ভূমি ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস ও ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নামক দুটি পৃথক সার্ভিস প্রণয়ন করা।
৮। কারিগরি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ ও নীতি-নির্ধারনে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্তি করার নীতিমালা প্রণয়ন করা; যার মাধ্যমে কারিগরি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভবপর হবে।
এর আগে জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ে প্রকৌশলীদের মধ্যে উন্মক্ত আলোচনার জন্য বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ কর্তৃক ‘পেশা যার, মন্ত্রণালয় তার’ শীর্ষক একটি সেমিনার আয়োজিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সদস্য ও নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সাবেক নির্বাহী পরিচালক, প্রকৌশলী জাহিদুর রশিদ। উক্ত সেমিনারে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত শতাধিক প্রকৌশলী অংশগ্রহণ করে তাদের মূল্যবান মতামত প্রদান করেন। সেমিনারে বক্তারা জানান সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৭০ ভাগই ব্যয় হয় প্রকৌশলীদের হাত ধরে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণী কর্মকাণ্ডে প্রকৌশলীদের অবদান রাখার সুযোগ খুবই কম। এর মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরই ক্যাডার সার্ভিস বহির্ভূত (যেমনঃ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য প্রযুক্তি, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ইত্যাদি)। সভায় বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন ও পরবর্তীতে পাকিস্তান আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সিভিল সার্ভিস থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকবারই সিভিল সার্ভিসকে পুনর্গঠিত করার কাজে হাত দিলেও তা খুব বেশী আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম.এ চৌধুরীকে প্রধান করে গঠন করা এএসআরসি কমিশন ও সাবেক সচিব আবদুর রশিদকে প্রধান করে তৈরী করা রশিদ কমিশন অন্যতম। প্রতিটি কমিশনই বৈষম্যহীন ও আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর কথা চিন্তা করে তাদের সুপারিশগুলো দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন পেশাভিত্তিক দ্বন্দ্বের কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অতীতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করেই জনপ্রশাসন সংস্কার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।