চুয়াডাঙ্গা ০২:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপির রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার বন্ধুত্ব চায়

বিএনপির রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের পারদ ওঠানামার ইতিহাস রয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ভারত বিরোধিতা ছিল, যদিও মাঝেমধ্যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বিকাশের চেষ্টাও চালিয়েছে। তবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাদের নানান মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সরাসরি ভারত বিরোধিতার সুর দেখা যাচ্ছে। অবশ্য দলটির নীতিনির্ধারক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, একদিকে ভারতের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা, পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা বিএনপির জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে।

 

আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবিরোধী কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। এমন কর্মসূচি আগামীতেও আসতে পারে। গতকাল বুধবার লং মার্চের মতো কর্মসূচি পালন এবং ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বিএনপির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভারতবিরোধী রাজনীতি। কিন্তু আদতে তেমনটি মনে করছেন না দলটির নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই দুই পক্ষের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুত্বও রাখবে। কারণ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপি টানাপড়েনের মধ্যে ছিল। আবার গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগকে একতরফা সমর্থনের ফল বর্তমানে উপলব্ধি করছে ভারত। ফলে দুই পক্ষে অভিজ্ঞতার উপলব্ধিতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির ভারসাম্যের সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হবে না বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। নানা বাস্তবতার কারণেই এমনটি করতে হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রাজনীতির মতোই কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতাই বিএনপি ও ভারতকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে বাধ্য। কেননা বিরোধী দলে থাকলে যেভাবে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করা যায়, কিন্তু ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে দেশ চালানো মুশকিল। সেই বাস্তবতা থেকেই বিএনপির সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক তৈরির তাগিদও রয়েছে।

ভারতের সঙ্গে বর্তমানে বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, ভারতের একচোখা নীতি। তাদের ভাষ্য, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও ভারত তাদের অবস্থানে বদল না আনায় বিএনপি বর্তমান নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের বক্তব্য-বিবৃতি দলটির ভেতরে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ফলে বিএনপি ভারতবিরোধী অবস্থান জোরালো করছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি দিয়েছে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। বিএনপি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ভারত। এর পেছনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও বিশ্বে তা ভিন্নভাবে প্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘিরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতীয় কর্র্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে অস্থিরতা তৈরি করছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া ও বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বিএনপিকে তাদের রাজনীতি করতে হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড আরও জোরালো হচ্ছে বিএনপির মধ্যে।

দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল পাল্টাতে হতে পারে। তবে, সরকার গঠন করতে পারলে ভারতকে উপেক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। ফলে, বিএনপি কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে ভারতীয় কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ভারতও সেই দিকে মনোযোগী। দেশটির পক্ষ থেকে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগের দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক বজায় রাখতে নানা সমস্যায় পড়তে হতে পারে, দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক কমে যাওয়ায়, ভারতের জন্য এটি একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশে এসেছেন, তারা প্রায়ই আসেন। এখন নতুন প্রেক্ষাপট। নতুন করে তিনি যা বলছেন, তাতে বোঝা যায়, সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর ছিল। সে জন্য সম্পর্কটা নতুন করে নতুন আঙ্গিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের যে চেতনাবোধ ও আকাক্সক্ষা সেটি উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হবে ভারত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা দেশের সঙ্গে দেশের হতে হবে, কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে নয়। পারস্পরিক স্বার্থকে সমুন্নত রেখে সমমর্যাদার ভিত্তিতে যদি বন্ধুত্ব থাকে; তাহলে সেটি উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর। বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কোনো প্রভুত্ব নয়। ছোট-বড় দেশ বলে কোনো কথা নেই। প্রতিটা দেশই কারও না কারও ওপর নির্ভরশীল।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতের ফারাক্কা নিয়ে লং মার্চ হয়েছিল। তারপরও সম্পর্কের অবনতি না হয়ে ওঠাপড়া হয়েছে। তবে ভারতের বিরোধিতার পাশাপাশি এই লংমার্চের (গতকালের) মধ্য দিয়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ দলটি বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ সুযোগ না দেওয়ায় বড় ধরনের জনসংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ভারতের বিষয়টা চলে আসায় বিএনপির জন্য সুবিধা হয়েছে। এমনিতেই তো কেউ লং মার্চ করতে পারে না।’ এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘ভারত বিরোধিতার জন্য যে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এমনটি নয়। কারণ ভারত ভালো করেই জানে বিএনপি এমনটা কেন করছে। সমস্যা যেটা হয়েছে তাহলো দিল্লি এদেশে একটা দলের সঙ্গে সম্পর্ক করেছিল, জনগণের সঙ্গে না। এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেটাকে সামাল দিতে ভারতও উদ্যোগী হবে। কারণ ভারতও বুঝতে পেরেছে একটা দলের সঙ্গে সম্পর্ক করে হয়তো কয়েক বছরের জন্য লাভ হয়। কিন্তু বড় আকারে লাভ হয় না।’

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তিনি (বিক্রম মিশ্রি) যে লিখিত স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, তারা এদেশে একটা নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, দলের সঙ্গে নয়, সেটা ভারত বুঝতে পেরেছে। আর বিএনপির সঙ্গে ভবিষ্যতে ভারত কাজ করতে গেলে খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপি আগে ক্ষমতায় ছিল, তাদের সঙ্গে ভারত কাজ করেছে। সম্পর্ক ওঠানামা হয়তো কিছুটা করেছে। কিন্তু কাজ করে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির ভারসাম্যের সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপি একটা সমস্যার (১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ইস্যু) মধ্য দিয়ে গেছে। আবার ৫ আগস্টের পর ভারতেরও একটা উপলব্ধি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে একটা ভারসাম্যের সম্পর্ক হয় কি না সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু বর্তমানে ভারতবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, তাই তাদের মনোভাব বুঝেই রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে এখনই কোনো ধরনের সম্পর্কে গেলে আগামী নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে দলটির নেতাদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। আবার সরকার গঠন করতে পারলে প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে উপেক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই বিএনপি ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করছে।

এরই মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের সঙ্গে তারা তাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক দৃঢ় করতে চান। এই সম্পর্কের মধ্যে কী করে আরও সুস্থতা, আরও পজেটিভিটি নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে তারা কাজ করতে আগ্রহী।’ ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর করার মতো আগ্রহ দেখা গেছে। দুটি কারণে ভারতের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। প্রথমত ভারত মনে করছে, বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন যখনই হোক, তাতে বিএনপির জয়ের ভালো সম্ভাবনা আছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাতে নানা সমস্যায় পড়বে। তাই কূটনৈতিকভাবে যতটুকু সম্ভব তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার কৌশল রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে না যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল জামায়াতে ইসলামী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে নানা মতপার্থক্য ও বিরোধের কারণ বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে অনেকটা ছেদ পড়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন পথে হাঁটাকে সম্পর্ক উন্নয়নে চমৎকার ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছে ভারত।

আবার ভারতকে চাপে রাখতে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথকভাবে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বৈঠকও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। এই বৈঠক এমন সময় হয়েছে যখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দৃঢ় হয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটিকে মেরূকরণ বলেও মনে করা হচ্ছে। বিএনপির কূটনৈতিক বিষয়াদি দেখেন এমন এক নেতা বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নানাভাবে সম্পর্কিত, সুতরাং আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকলে বহু ধরনের সুবিধা ভোগ করতে পারি। অর্থনৈতিক, ব্যবসা, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারি। ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, মর্যাদার ভিত্তিতে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অন্ধ ভারতবিরোধিতা অথবা অন্ধ বাংলাদেশবিরোধিতা এটা এই যুগের কোনো পলিসি হতে পারে না।’

এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের যে অসন্তোষ সেটা সাম্প্রদায়িক না, রাজনৈতিক। ভারত গত দেড় দশক ধরে একটা দলকে প্রশ্নহীন সমর্থন জোগাতে গিয়ে গোটা বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের পরিবর্তন আনা দরকার। আর মনস্তাত্ত্বিকভাবে ৫ আগস্টের পর যে পরিবর্তন, এই পরিবর্তনটাকে ভারত যদি মেনে না নেয়, তাহলে ভারতের দিক থেকে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করাটা কঠিন। কারণ ভারতের সঙ্গে তার কোনো প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো নয়। তাই ভারতকে নতুন চেতনায় হওয়া গণ-অভ্যুত্থান মেনে নিয়ে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তাদের দিক থেকে এগিয়ে আসার দরকার। অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমতার ভিত্তিতে সমাধান করতে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে চাপে রেখে বা দমনে রেখে অনুগত রাষ্ট্র করার যে নীতি-কৌশল, এটাকে পরিবর্তন করতে হবে। তা নাহলে কোনো সম্পর্ক হবে না। সেভেন সিস্টারের জন্য ভারতে ট্রানজিট দরকার, করিডর দরকার, বন্দরের কিছু সুবিধা দরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রেখে তা হবে না। ভারতের ১০টা কার্ড হাতে থাকলে, বাংলাদেশেরও ২টা কার্ড হাতে আছে।

তথ্য পর্যালোচনা বলছে, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে তার শাসনকালে ভারতবিরোধিতা করতে দেখা গেছে। মাঝে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর সেই বিরোধিতা কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবার সম্পর্কে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার করার চেষ্টা হয়েছিল, তাতে ভারতের বৈরী একটি দেশের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছিল বলে ভারতের কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক মনে করেন। তবে এক-এগারোর পর বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জোর চেষ্টা চালায়। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভারত সফরে গেলে দেশটির তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা দেওয়া হয়। বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে বৈঠক হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পদস্থ সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার। এর ঠিক ছয় মাসের মাথায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এলে তার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন খালেদা জিয়া। সেদিন জামায়াতের ডাকে হরতাল চলছিল। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ওই ঘটনায় ভারত এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে, খালেদার সফরের মধ্য দিয়ে প্রায় ঘুচে যাওয়া ‘দুর্নাম’ নতুন করে সামনে আসে।

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনসহ গত ১৫ বছরে ভারত একতরফা শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে গেলে বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। জানতে চাইলে বিএনপির জোটসঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। আমরা চাইলেও প্রতিবেশী পাল্টাতে পারব না। দিন শেষে ভারতের সঙ্গে আমাদের ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ লাগবে। এটা ভারতের দিক থেকেও লাগবে। এক্ষেত্রে সম্পর্কটা হবে পারস্পরিক সম্মান, সমস্বার্থ ও মর্যাদার ভিত্তিতে।’

সুত্র লিংক

প্রসংঙ্গ :

নির্বাচনকে বিএনপি প্রাধান্য দিচ্ছে এমন ধারণা ভুল: ফখরুল

avashnews

Powered by WooCommerce

বিএনপির রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার বন্ধুত্ব চায়

আপডেটঃ ১২:৪৭:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

বিএনপির রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের পারদ ওঠানামার ইতিহাস রয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ভারত বিরোধিতা ছিল, যদিও মাঝেমধ্যে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বিকাশের চেষ্টাও চালিয়েছে। তবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাদের নানান মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সরাসরি ভারত বিরোধিতার সুর দেখা যাচ্ছে। অবশ্য দলটির নীতিনির্ধারক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, একদিকে ভারতের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা, পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা বিএনপির জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে।

 

আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবিরোধী কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। এমন কর্মসূচি আগামীতেও আসতে পারে। গতকাল বুধবার লং মার্চের মতো কর্মসূচি পালন এবং ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, বিএনপির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভারতবিরোধী রাজনীতি। কিন্তু আদতে তেমনটি মনে করছেন না দলটির নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই দুই পক্ষের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুত্বও রাখবে। কারণ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপি টানাপড়েনের মধ্যে ছিল। আবার গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দিয়ে আওয়ামী লীগকে একতরফা সমর্থনের ফল বর্তমানে উপলব্ধি করছে ভারত। ফলে দুই পক্ষে অভিজ্ঞতার উপলব্ধিতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির ভারসাম্যের সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হবে না বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। নানা বাস্তবতার কারণেই এমনটি করতে হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রাজনীতির মতোই কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতাই বিএনপি ও ভারতকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে বাধ্য। কেননা বিরোধী দলে থাকলে যেভাবে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করা যায়, কিন্তু ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে দেশ চালানো মুশকিল। সেই বাস্তবতা থেকেই বিএনপির সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক তৈরির তাগিদও রয়েছে।

ভারতের সঙ্গে বর্তমানে বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, ভারতের একচোখা নীতি। তাদের ভাষ্য, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও ভারত তাদের অবস্থানে বদল না আনায় বিএনপি বর্তমান নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের বক্তব্য-বিবৃতি দলটির ভেতরে ক্ষোভ তৈরি করেছে। ফলে বিএনপি ভারতবিরোধী অবস্থান জোরালো করছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি দিয়েছে দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। বিএনপি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ভারত। এর পেছনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার ভূমিকা রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও বিশ্বে তা ভিন্নভাবে প্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘিরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতীয় কর্র্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে অস্থিরতা তৈরি করছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া ও বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বিএনপিকে তাদের রাজনীতি করতে হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড আরও জোরালো হচ্ছে বিএনপির মধ্যে।

দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল পাল্টাতে হতে পারে। তবে, সরকার গঠন করতে পারলে ভারতকে উপেক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। ফলে, বিএনপি কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে ভারতীয় কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ভারতও সেই দিকে মনোযোগী। দেশটির পক্ষ থেকে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগের দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক বজায় রাখতে নানা সমস্যায় পড়তে হতে পারে, দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক কমে যাওয়ায়, ভারতের জন্য এটি একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশে এসেছেন, তারা প্রায়ই আসেন। এখন নতুন প্রেক্ষাপট। নতুন করে তিনি যা বলছেন, তাতে বোঝা যায়, সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর ছিল। সে জন্য সম্পর্কটা নতুন করে নতুন আঙ্গিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের যে চেতনাবোধ ও আকাক্সক্ষা সেটি উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হবে ভারত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা দেশের সঙ্গে দেশের হতে হবে, কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে নয়। পারস্পরিক স্বার্থকে সমুন্নত রেখে সমমর্যাদার ভিত্তিতে যদি বন্ধুত্ব থাকে; তাহলে সেটি উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর। বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কোনো প্রভুত্ব নয়। ছোট-বড় দেশ বলে কোনো কথা নেই। প্রতিটা দেশই কারও না কারও ওপর নির্ভরশীল।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতের ফারাক্কা নিয়ে লং মার্চ হয়েছিল। তারপরও সম্পর্কের অবনতি না হয়ে ওঠাপড়া হয়েছে। তবে ভারতের বিরোধিতার পাশাপাশি এই লংমার্চের (গতকালের) মধ্য দিয়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ দলটি বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ সুযোগ না দেওয়ায় বড় ধরনের জনসংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ভারতের বিষয়টা চলে আসায় বিএনপির জন্য সুবিধা হয়েছে। এমনিতেই তো কেউ লং মার্চ করতে পারে না।’ এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘ভারত বিরোধিতার জন্য যে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এমনটি নয়। কারণ ভারত ভালো করেই জানে বিএনপি এমনটা কেন করছে। সমস্যা যেটা হয়েছে তাহলো দিল্লি এদেশে একটা দলের সঙ্গে সম্পর্ক করেছিল, জনগণের সঙ্গে না। এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেটাকে সামাল দিতে ভারতও উদ্যোগী হবে। কারণ ভারতও বুঝতে পেরেছে একটা দলের সঙ্গে সম্পর্ক করে হয়তো কয়েক বছরের জন্য লাভ হয়। কিন্তু বড় আকারে লাভ হয় না।’

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তিনি (বিক্রম মিশ্রি) যে লিখিত স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, তারা এদেশে একটা নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে, দলের সঙ্গে নয়, সেটা ভারত বুঝতে পেরেছে। আর বিএনপির সঙ্গে ভবিষ্যতে ভারত কাজ করতে গেলে খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপি আগে ক্ষমতায় ছিল, তাদের সঙ্গে ভারত কাজ করেছে। সম্পর্ক ওঠানামা হয়তো কিছুটা করেছে। কিন্তু কাজ করে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির ভারসাম্যের সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপি একটা সমস্যার (১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ইস্যু) মধ্য দিয়ে গেছে। আবার ৫ আগস্টের পর ভারতেরও একটা উপলব্ধি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে একটা ভারসাম্যের সম্পর্ক হয় কি না সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু বর্তমানে ভারতবিরোধী অবস্থানে রয়েছে, তাই তাদের মনোভাব বুঝেই রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে এখনই কোনো ধরনের সম্পর্কে গেলে আগামী নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে দলটির নেতাদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। আবার সরকার গঠন করতে পারলে প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে উপেক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই বিএনপি ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করছে।

এরই মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে তারা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের সঙ্গে তারা তাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক দৃঢ় করতে চান। এই সম্পর্কের মধ্যে কী করে আরও সুস্থতা, আরও পজেটিভিটি নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে তারা কাজ করতে আগ্রহী।’ ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর করার মতো আগ্রহ দেখা গেছে। দুটি কারণে ভারতের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। প্রথমত ভারত মনে করছে, বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন যখনই হোক, তাতে বিএনপির জয়ের ভালো সম্ভাবনা আছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাতে নানা সমস্যায় পড়বে। তাই কূটনৈতিকভাবে যতটুকু সম্ভব তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার কৌশল রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে না যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল জামায়াতে ইসলামী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে নানা মতপার্থক্য ও বিরোধের কারণ বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে অনেকটা ছেদ পড়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন পথে হাঁটাকে সম্পর্ক উন্নয়নে চমৎকার ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছে ভারত।

আবার ভারতকে চাপে রাখতে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথকভাবে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বৈঠকও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। এই বৈঠক এমন সময় হয়েছে যখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দৃঢ় হয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটিকে মেরূকরণ বলেও মনে করা হচ্ছে। বিএনপির কূটনৈতিক বিষয়াদি দেখেন এমন এক নেতা বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নানাভাবে সম্পর্কিত, সুতরাং আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকলে বহু ধরনের সুবিধা ভোগ করতে পারি। অর্থনৈতিক, ব্যবসা, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারি। ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, মর্যাদার ভিত্তিতে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অন্ধ ভারতবিরোধিতা অথবা অন্ধ বাংলাদেশবিরোধিতা এটা এই যুগের কোনো পলিসি হতে পারে না।’

এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের যে অসন্তোষ সেটা সাম্প্রদায়িক না, রাজনৈতিক। ভারত গত দেড় দশক ধরে একটা দলকে প্রশ্নহীন সমর্থন জোগাতে গিয়ে গোটা বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের পরিবর্তন আনা দরকার। আর মনস্তাত্ত্বিকভাবে ৫ আগস্টের পর যে পরিবর্তন, এই পরিবর্তনটাকে ভারত যদি মেনে না নেয়, তাহলে ভারতের দিক থেকে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করাটা কঠিন। কারণ ভারতের সঙ্গে তার কোনো প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো নয়। তাই ভারতকে নতুন চেতনায় হওয়া গণ-অভ্যুত্থান মেনে নিয়ে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তাদের দিক থেকে এগিয়ে আসার দরকার। অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমতার ভিত্তিতে সমাধান করতে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে চাপে রেখে বা দমনে রেখে অনুগত রাষ্ট্র করার যে নীতি-কৌশল, এটাকে পরিবর্তন করতে হবে। তা নাহলে কোনো সম্পর্ক হবে না। সেভেন সিস্টারের জন্য ভারতে ট্রানজিট দরকার, করিডর দরকার, বন্দরের কিছু সুবিধা দরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রেখে তা হবে না। ভারতের ১০টা কার্ড হাতে থাকলে, বাংলাদেশেরও ২টা কার্ড হাতে আছে।

তথ্য পর্যালোচনা বলছে, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে তার শাসনকালে ভারতবিরোধিতা করতে দেখা গেছে। মাঝে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর সেই বিরোধিতা কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবার সম্পর্কে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার করার চেষ্টা হয়েছিল, তাতে ভারতের বৈরী একটি দেশের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছিল বলে ভারতের কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক মনে করেন। তবে এক-এগারোর পর বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জোর চেষ্টা চালায়। ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভারত সফরে গেলে দেশটির তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা দেওয়া হয়। বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে বৈঠক হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পদস্থ সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার। এর ঠিক ছয় মাসের মাথায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এলে তার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন খালেদা জিয়া। সেদিন জামায়াতের ডাকে হরতাল চলছিল। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ওই ঘটনায় ভারত এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে, খালেদার সফরের মধ্য দিয়ে প্রায় ঘুচে যাওয়া ‘দুর্নাম’ নতুন করে সামনে আসে।

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনসহ গত ১৫ বছরে ভারত একতরফা শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে গেলে বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। জানতে চাইলে বিএনপির জোটসঙ্গী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। আমরা চাইলেও প্রতিবেশী পাল্টাতে পারব না। দিন শেষে ভারতের সঙ্গে আমাদের ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ লাগবে। এটা ভারতের দিক থেকেও লাগবে। এক্ষেত্রে সম্পর্কটা হবে পারস্পরিক সম্মান, সমস্বার্থ ও মর্যাদার ভিত্তিতে।’

সুত্র লিংক