চুয়াডাঙ্গা ০৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গোপসাগরে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে হাঙ্গর : সুরক্ষা শুধু কাগজে-কলমে


নতুন ফিসারিঘাট এলাকার জেলে প্রফুল্ল জলদাশ টিবিএসকে বলেন, ‍‍”আগে টার্গেট করে হাঙ্গর মাছ ধরা হয়নি। হাঙ্গর-ডরফিন জালে আসলে আসলে ছেড়ে দেওয়া হতো। এখন অনেক ট্রলার হাঙ্গর বা অন্যান্য বড় মাছ শিকারের জন্য বড় লোহার হুক সাগরে নিয়ে যায়।”

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জে.কে -৩, সি-হার্ট, লাবিবা শিপিং, সি-ফুডসহ প্রায় ৪০ টি জাহাজ ও ১০ হাজার ট্রলার প্রতিদিনই অন্যান্য মাছের সঙ্গে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা (স্টিং-রে) নিয়ে আসে। সাগর থেকে আসা এসব হাঙ্গরের ঠাই হয় চট্টগ্রাম নগরের মাঝিরঘাটের সবচেয়ে বড় কর্ণফূলি স্টোরেজ,আল্লাহর দান স্টোরেজ, শাহ আজিজ স্টোরেজসহ কর্ণফূলী নদীর দুই তীরের অন্তত ৩০ টি মাছের আড়তে। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ টন ওজনের হাঙ্গরও কিনতে পাওয়া যায়।

সোমবার সন্ধ্যায় কর্ণফূলি স্টোরেজে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই হাঙ্গর ক্রয় করছেন। আকার ভেদে কেজি প্রতি ২০০ টাকা থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে হাঙ্গর। এ সময় হাঙ্গর বিক্রেতা জয় এন্টারপ্রাইজের সত্বাধীকারী সুব্রতের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “জেলেদের সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। হাঙ্গর শিকার হলেই তারা আমাদের কাছে নিয়ে আসে। এখান থেকে সারাদেশে পাঠানো হয়।”

হাঙ্গর বিক্রিতে কোনো বাধা আছে কিনা জানতে চাইলে সুব্রত বলেন, ‍‍‍‍”এখানেই বছরের পর বছর ধরে হাঙ্গরের ব্যবসা করছি। কখনো পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থা অভিযান পরিচালনা করেনি।” এসময় তিনি নিজেই হাঙ্গর ভর্তি স্টোরেজটি এই প্রতিবেদককে ঘুড়িয়ে দেখান।

শাহ আজিজ স্টোরেজের কর্মচারি নুরুল আলম বলেন, “বেশ কিছু জাহাজ রয়েছে যারা শুধু হাঙ্গর শিকার করে। জাহাজ গুলো ১২ তেকে ১৫ দিন পরপর হাঙ্গর, করাত মাছ ও শাপলাপাতা নিয়ে ফেরে। প্রথমে স্টোরেজ করার পর এসব মাছ নগরের নতুন ও পুরাতন ফিশারী ঘাট এলাকায় পাঠানো হয়; মূলত সেখানেই হয় হাঙ্গরের বেচাকেনা।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে অঞ্চলের বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দাবি করেন, প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে তাঁরা অভিযান পরিচালনা করছেন। তবে সাত মাসে পরিচালিত অভিযানের সংখ্য মাত্র তিনটি।

তবে বন সংরক্ষক প্রধান মোল্লা রেজাউল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “স্থানীয় ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সব ধরনের নির্দেশ দেওয়া আছে। তিনি চাইলেই র‌্যাব-পুলিশ বা কোস্টগার্ডকে ব্যবহার করে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেন। এটা কেন হচ্ছেনা বিষয়টি তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে।”

কালোবাজারে বাংলাদেশি হাঙ্গরের পাখনা 

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাফিক’র একটি জরিপ অনুযায়ি, পৃথিবী জুড়ে শীর্ষ ২০ দেশে প্রতি বছর তিন লাখ ৩৩ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন হাঙ্গর ও রে ফিশ ধরা পড়ছে। তাদের হিসেবে হাঙ্গর ও রে ফিশের ১৭ শতাংশই রয়েছে ‘অতি বিপন্ন’ তালিকায়।

হাঙ্গর রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ২০তম। প্রাণী বিষয়ক আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইউসিএনের রেড লিস্টেও উঠে এসেছে বিষয়টি।

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

“>
whatsapp image 2022 03 29 at 17.36.27 1

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের উপ পরিচালক আবদুর রউফ বলেন বলেন, “দেশে কিছু কিছু এলাকার মানুষ হাঙ্গরের মাংস ও শুটকি খেতে পছন্দ করে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে হাঙ্গরের মাংস, পাখনা, চামড়া এবং হাড় রপ্তানী হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।” 

ব্যবসায়িরা জানান, হাঙ্গর ও স্টিং-রে প্রক্রিয়াকরণের সময় এসবের কোনো অংশই ফেলে দেওয়া হয় না। এর মধ্যে রয়েছে তাজা এবং শুকনো মাংস, চামড়া, কশেরুকা, চোয়াল, দাঁত, পাখনা, শুকনো গোটা মাছ, অন্ত্র, করাত মাছের রোস্ট্রাম, লিভার এবং লিভারের তেল এবং মবুলিড রে ফিস প্লেট। এসবের প্রায় সব পণ্যই রপ্তানি করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয় হাঙ্গর শুটকি, লিভারের তেল, হাড়, চোয়াল, দাঁত এবং অন্ত্র।

চট্টগ্রামে পুরাতন ফিসারিঘাট এলাকার মাছের আড়ত গুলোতে সরেজমিন ঘুড়ে দেখা গেছে, এসব আড়তের ফ্রিজ গুলোতে সংরক্ষিত হাঙ্গরের সবগুলোরই পাখনা ও লেজ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়িরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের কারণে হাঙ্গরের পাখনা ও লেজ দেশে থাকে না, পাচার হয়ে যায়।

জাপানী এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধীকারী সুধাংশু দাশ (জাপানী) বলেন, “৫০ বছর ধরে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা বিক্রি করছি। এটি বিক্রি যে নিষিদ্ধ সে সম্পর্কে কেউ আমাদের কখনো বলেনি। ধর্মীয় কারণে এই পণ্যগুলি খাওয়া মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। তবে  উপজাতীয় লোকদের জন্য নির্বাচিত বিক্রেতাদের মাধ্যমে পাহাড়ে শুটকি পাঠানো হয়। পাখনাসহ বাকি সব কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও বড় বাজার রয়েছে।”

ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের পটুয়াখালী এলাকার গবেষণা সহযোগী সাগরিকা স্মৃতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‍‍”পটুয়াখালী, সোনাদিয়া, দুলারচর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলে হাঙ্গর শিকার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখানে শিকার হওয়া হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ যাচ্ছে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে মিয়ানমার হয়ে বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক ব্যাক্তি ও অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত।”

চট্টগ্রামের নগরের বাকলিয়া থানার বাস্তুহারা এলাকায় হাঙ্গর প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখতে গেলে প্রথমে ব্যবসায়ীরা বিষয়টি আড়ালে রাখতে চেষ্টা করেন। নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক ব্যবসায়ি এই প্রতিবেদককে বলেন, “গোপনে চট্টগ্রাম থেকে হাঙ্গারের শুকনো অন্ত্র, হাতুড়ির মাথা, কশেরুকা, চোয়াল, দাঁত, স্নাউটস, পাখনা, শুকনো মাংস, তরুণাস্থি, লিভার, লিভার তেল, তাজা মাংস বিদেশে পাচার করা হয়।”

আসাদগঞ্জের শুটকি ব্যবসায়ি আকবর হাসান বলেন, “স্থানীয় ভাবে যারা হাঙ্গর বিক্রি করছে বা শুটকি করছে তারা কেউ এসব বিদেশে রপ্তানী বা পাচারের সঙ্গে জড়িত না। অনেক বড় বড় পার্টি আছে যারা সরাসরি বা দালালের মাধ্যমে হাঙ্গর সংগ্রহ করে। তারাই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে মায়ানমার পাচার করেছে।”

“অবজারভেশনস অব শার্ক অ্যান্ড রে প্রোডাক্টস ইন দ্য প্রসেসিং সেন্টারস অব বাংলাদেশ, ট্রেড ইন সাইটস স্পিসিস অ্যান্ড কনজারভেশন নিডেড” শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইন্টারনেট অনুসন্ধানে বাংলাদেশে হাঙ্গরের মাংস এবং যকৃতের তেলের ব্যবসা সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে। এসব হাঙ্গর লিভার অয়েল, কার্টিলেজ এবং বিভিন্ন কিউরির বিশ্বব্যাপী ভোক্তা এবং সংগ্রাহক রয়েছে। তবে বাংলাদেশের জেলেদের এই অনলাইন ব্যবসায়িক পরিষেবাগুলির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন। মূলত একটি সুবিধাবাদী গোষ্টি এই জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়। তারাই কালোবাজারে হাঙ্গরের মাংস, পাখনা এবং চামড়া সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশি হাঙ্গরের পাখনা দিয়ে তৈরী সূপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে চীনে। এছাড়া হাঙ্গর পাচার হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে।

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

“>
whatsapp image 2022 03 29 at 17.36.22

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এর গবেষক আলিফা বিনতে হক বলেন, “আমরা অনেক জেলেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে না চাইলেও জালে হাঙ্গর ধরা পরে। সেই হাঙ্গর যখন ঘাটে আসে তখন এর একটি দাম তৈরী হয়। কিন্তু অনিচছায় শিকার করা এই মাছের জন্য দরিদ্র জেলেকে জরিমানা করা হয়, তাহলে সে মাছটি সাগরে ফেলে আসবে। যে মানুষটা ৪০ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করছে তাকে হটাৎ করে জরিমানা করা হলে বিষয়টি অস্বাভাবিক হবে।”

“যেখানে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ইতিমধ্যে হাঙ্গরের একটি বাজার রয়েছে। বেশ ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এটি বন্ধ রাখা যাবে না। অন্যথায় বাজারটি কালোবাজারিদের হাতে চলে যাবে। তার চেয়ে হাঙ্গরের যে প্রজাতী গুলো ট্রেড করা যাবে তা নিয়ে জেলেদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাই হাঙ্গর ও শাপলাপাতা রক্ষায় শুধু মাত্র আইন প্রয়োগের চিন্তা না করে কিভাবে সাগরে শিকার নিষিদ্ধ হাঙ্গরকে রক্ষা করে বাকি মাছ শিকার করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ বাঘ সুরক্ষা আর হাঙ্গর সুরক্ষা এক নয়।”





Source link

প্রসংঙ্গ :

Powered by WooCommerce

বঙ্গোপসাগরে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে হাঙ্গর : সুরক্ষা শুধু কাগজে-কলমে

আপডেটঃ ১১:৫৭:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪


নতুন ফিসারিঘাট এলাকার জেলে প্রফুল্ল জলদাশ টিবিএসকে বলেন, ‍‍”আগে টার্গেট করে হাঙ্গর মাছ ধরা হয়নি। হাঙ্গর-ডরফিন জালে আসলে আসলে ছেড়ে দেওয়া হতো। এখন অনেক ট্রলার হাঙ্গর বা অন্যান্য বড় মাছ শিকারের জন্য বড় লোহার হুক সাগরে নিয়ে যায়।”

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জে.কে -৩, সি-হার্ট, লাবিবা শিপিং, সি-ফুডসহ প্রায় ৪০ টি জাহাজ ও ১০ হাজার ট্রলার প্রতিদিনই অন্যান্য মাছের সঙ্গে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা (স্টিং-রে) নিয়ে আসে। সাগর থেকে আসা এসব হাঙ্গরের ঠাই হয় চট্টগ্রাম নগরের মাঝিরঘাটের সবচেয়ে বড় কর্ণফূলি স্টোরেজ,আল্লাহর দান স্টোরেজ, শাহ আজিজ স্টোরেজসহ কর্ণফূলী নদীর দুই তীরের অন্তত ৩০ টি মাছের আড়তে। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ টন ওজনের হাঙ্গরও কিনতে পাওয়া যায়।

সোমবার সন্ধ্যায় কর্ণফূলি স্টোরেজে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই হাঙ্গর ক্রয় করছেন। আকার ভেদে কেজি প্রতি ২০০ টাকা থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে হাঙ্গর। এ সময় হাঙ্গর বিক্রেতা জয় এন্টারপ্রাইজের সত্বাধীকারী সুব্রতের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “জেলেদের সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। হাঙ্গর শিকার হলেই তারা আমাদের কাছে নিয়ে আসে। এখান থেকে সারাদেশে পাঠানো হয়।”

হাঙ্গর বিক্রিতে কোনো বাধা আছে কিনা জানতে চাইলে সুব্রত বলেন, ‍‍‍‍”এখানেই বছরের পর বছর ধরে হাঙ্গরের ব্যবসা করছি। কখনো পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থা অভিযান পরিচালনা করেনি।” এসময় তিনি নিজেই হাঙ্গর ভর্তি স্টোরেজটি এই প্রতিবেদককে ঘুড়িয়ে দেখান।

শাহ আজিজ স্টোরেজের কর্মচারি নুরুল আলম বলেন, “বেশ কিছু জাহাজ রয়েছে যারা শুধু হাঙ্গর শিকার করে। জাহাজ গুলো ১২ তেকে ১৫ দিন পরপর হাঙ্গর, করাত মাছ ও শাপলাপাতা নিয়ে ফেরে। প্রথমে স্টোরেজ করার পর এসব মাছ নগরের নতুন ও পুরাতন ফিশারী ঘাট এলাকায় পাঠানো হয়; মূলত সেখানেই হয় হাঙ্গরের বেচাকেনা।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে অঞ্চলের বন সংরক্ষক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দাবি করেন, প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে তাঁরা অভিযান পরিচালনা করছেন। তবে সাত মাসে পরিচালিত অভিযানের সংখ্য মাত্র তিনটি।

তবে বন সংরক্ষক প্রধান মোল্লা রেজাউল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “স্থানীয় ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সব ধরনের নির্দেশ দেওয়া আছে। তিনি চাইলেই র‌্যাব-পুলিশ বা কোস্টগার্ডকে ব্যবহার করে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখেন। এটা কেন হচ্ছেনা বিষয়টি তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে।”

কালোবাজারে বাংলাদেশি হাঙ্গরের পাখনা 

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাফিক’র একটি জরিপ অনুযায়ি, পৃথিবী জুড়ে শীর্ষ ২০ দেশে প্রতি বছর তিন লাখ ৩৩ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন হাঙ্গর ও রে ফিশ ধরা পড়ছে। তাদের হিসেবে হাঙ্গর ও রে ফিশের ১৭ শতাংশই রয়েছে ‘অতি বিপন্ন’ তালিকায়।

হাঙ্গর রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ২০তম। প্রাণী বিষয়ক আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইউসিএনের রেড লিস্টেও উঠে এসেছে বিষয়টি।

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

“>
whatsapp image 2022 03 29 at 17.36.27 1

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের উপ পরিচালক আবদুর রউফ বলেন বলেন, “দেশে কিছু কিছু এলাকার মানুষ হাঙ্গরের মাংস ও শুটকি খেতে পছন্দ করে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে হাঙ্গরের মাংস, পাখনা, চামড়া এবং হাড় রপ্তানী হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।” 

ব্যবসায়িরা জানান, হাঙ্গর ও স্টিং-রে প্রক্রিয়াকরণের সময় এসবের কোনো অংশই ফেলে দেওয়া হয় না। এর মধ্যে রয়েছে তাজা এবং শুকনো মাংস, চামড়া, কশেরুকা, চোয়াল, দাঁত, পাখনা, শুকনো গোটা মাছ, অন্ত্র, করাত মাছের রোস্ট্রাম, লিভার এবং লিভারের তেল এবং মবুলিড রে ফিস প্লেট। এসবের প্রায় সব পণ্যই রপ্তানি করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয় হাঙ্গর শুটকি, লিভারের তেল, হাড়, চোয়াল, দাঁত এবং অন্ত্র।

চট্টগ্রামে পুরাতন ফিসারিঘাট এলাকার মাছের আড়ত গুলোতে সরেজমিন ঘুড়ে দেখা গেছে, এসব আড়তের ফ্রিজ গুলোতে সংরক্ষিত হাঙ্গরের সবগুলোরই পাখনা ও লেজ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়িরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের কারণে হাঙ্গরের পাখনা ও লেজ দেশে থাকে না, পাচার হয়ে যায়।

জাপানী এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধীকারী সুধাংশু দাশ (জাপানী) বলেন, “৫০ বছর ধরে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা বিক্রি করছি। এটি বিক্রি যে নিষিদ্ধ সে সম্পর্কে কেউ আমাদের কখনো বলেনি। ধর্মীয় কারণে এই পণ্যগুলি খাওয়া মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। তবে  উপজাতীয় লোকদের জন্য নির্বাচিত বিক্রেতাদের মাধ্যমে পাহাড়ে শুটকি পাঠানো হয়। পাখনাসহ বাকি সব কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরও বড় বাজার রয়েছে।”

ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের পটুয়াখালী এলাকার গবেষণা সহযোগী সাগরিকা স্মৃতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‍‍”পটুয়াখালী, সোনাদিয়া, দুলারচর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলে হাঙ্গর শিকার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখানে শিকার হওয়া হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ যাচ্ছে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে মিয়ানমার হয়ে বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক ব্যাক্তি ও অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত।”

চট্টগ্রামের নগরের বাকলিয়া থানার বাস্তুহারা এলাকায় হাঙ্গর প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখতে গেলে প্রথমে ব্যবসায়ীরা বিষয়টি আড়ালে রাখতে চেষ্টা করেন। নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক ব্যবসায়ি এই প্রতিবেদককে বলেন, “গোপনে চট্টগ্রাম থেকে হাঙ্গারের শুকনো অন্ত্র, হাতুড়ির মাথা, কশেরুকা, চোয়াল, দাঁত, স্নাউটস, পাখনা, শুকনো মাংস, তরুণাস্থি, লিভার, লিভার তেল, তাজা মাংস বিদেশে পাচার করা হয়।”

আসাদগঞ্জের শুটকি ব্যবসায়ি আকবর হাসান বলেন, “স্থানীয় ভাবে যারা হাঙ্গর বিক্রি করছে বা শুটকি করছে তারা কেউ এসব বিদেশে রপ্তানী বা পাচারের সঙ্গে জড়িত না। অনেক বড় বড় পার্টি আছে যারা সরাসরি বা দালালের মাধ্যমে হাঙ্গর সংগ্রহ করে। তারাই চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে মায়ানমার পাচার করেছে।”

“অবজারভেশনস অব শার্ক অ্যান্ড রে প্রোডাক্টস ইন দ্য প্রসেসিং সেন্টারস অব বাংলাদেশ, ট্রেড ইন সাইটস স্পিসিস অ্যান্ড কনজারভেশন নিডেড” শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইন্টারনেট অনুসন্ধানে বাংলাদেশে হাঙ্গরের মাংস এবং যকৃতের তেলের ব্যবসা সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে। এসব হাঙ্গর লিভার অয়েল, কার্টিলেজ এবং বিভিন্ন কিউরির বিশ্বব্যাপী ভোক্তা এবং সংগ্রাহক রয়েছে। তবে বাংলাদেশের জেলেদের এই অনলাইন ব্যবসায়িক পরিষেবাগুলির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন। মূলত একটি সুবিধাবাদী গোষ্টি এই জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়। তারাই কালোবাজারে হাঙ্গরের মাংস, পাখনা এবং চামড়া সরবরাহ করছে।

বাংলাদেশি হাঙ্গরের পাখনা দিয়ে তৈরী সূপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে চীনে। এছাড়া হাঙ্গর পাচার হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে।

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

“>
whatsapp image 2022 03 29 at 17.36.22

ছবি: মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এর গবেষক আলিফা বিনতে হক বলেন, “আমরা অনেক জেলেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে না চাইলেও জালে হাঙ্গর ধরা পরে। সেই হাঙ্গর যখন ঘাটে আসে তখন এর একটি দাম তৈরী হয়। কিন্তু অনিচছায় শিকার করা এই মাছের জন্য দরিদ্র জেলেকে জরিমানা করা হয়, তাহলে সে মাছটি সাগরে ফেলে আসবে। যে মানুষটা ৪০ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করছে তাকে হটাৎ করে জরিমানা করা হলে বিষয়টি অস্বাভাবিক হবে।”

“যেখানে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ইতিমধ্যে হাঙ্গরের একটি বাজার রয়েছে। বেশ ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এটি বন্ধ রাখা যাবে না। অন্যথায় বাজারটি কালোবাজারিদের হাতে চলে যাবে। তার চেয়ে হাঙ্গরের যে প্রজাতী গুলো ট্রেড করা যাবে তা নিয়ে জেলেদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাই হাঙ্গর ও শাপলাপাতা রক্ষায় শুধু মাত্র আইন প্রয়োগের চিন্তা না করে কিভাবে সাগরে শিকার নিষিদ্ধ হাঙ্গরকে রক্ষা করে বাকি মাছ শিকার করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ বাঘ সুরক্ষা আর হাঙ্গর সুরক্ষা এক নয়।”





Source link